শিরোনাম:
ঢাকা, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ৫ অগ্রহায়ন ১৪৩২
Swadeshvumi
মঙ্গলবার ● ১৮ নভেম্বর ২০২৫
প্রচ্ছদ » প্রধান সংবাদ » শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড, বাংলাদেশের রাজনীতির সন্ধিক্ষণ!
প্রচ্ছদ » প্রধান সংবাদ » শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড, বাংলাদেশের রাজনীতির সন্ধিক্ষণ!
৪ বার পঠিত
মঙ্গলবার ● ১৮ নভেম্বর ২০২৫
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড, বাংলাদেশের রাজনীতির সন্ধিক্ষণ!

শায়লা শবনব

---

বাংলাদেশের আধুনিক রাষ্ট্রীয় রাজনীতিতে ১৭ নভেম্বর ২০২৫ নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী দিন। দীর্ঘ চার দশকের রাজনৈতিক প্রভাব, টানা পনেরো বছরের বেশি শাসন এবং ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বছরখানেকের ব্যবধানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হলেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এই রায় কেবল একটি মামলার সমাপ্তি নয়, বরং বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা, রাজনৈতিক জবাবদিহি এবং রাষ্ট্রশক্তির চরিত্র নিয়ে নতুন বিতর্ক ও সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে।

ক্ষমতা থেকে আদালতের কাঠগড়ায় একটি দ্রুত পতনের ইতিহাস

২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান ছিল দীর্ঘদিনের কেন্দ্রীয়কৃত শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে চাপা ক্ষোভের বিস্ফোরণ। সে সময়কার দমনপীড়ন, হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ, আশুলিয়া ও চানখাঁরপুলে হত্যাকাণ্ড সব মিলিয়ে রাষ্ট্রীয় সহিংসতার অভিযোগ নতুন করে সামনে আসে। তবে কারা আদেশ দিয়েছিলেন, কোন পর্যায়ের অনুমোদনে এসব হামলা হয়েছে এসব প্রশ্ন তখন অনুত্তরিত ছিল।

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর শেখ হাসিনার ভারত যাত্রা পরিস্থিতিকে আরেক দিক থেকে জটিল করে। বহু বিশ্লেষকের মতে, তাঁর দেশে ফিরে না আসা রাজনৈতিক ও বিচারিক প্রক্রিয়াকে নতুন মাত্রা দেয়। পলাতক থাকার কারণে তাঁর আপিলের সুযোগ না পাওয়া রায়কে আরও বিতর্কিত ও নজিরবিহীন করেছে।

রায়ের ভিত্তি: সাক্ষ্য প্রমাণের শক্তি ও রাজসাক্ষীর ভূমিকা

এই মামলায় সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মোড় আসে সাবেক পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের জবানবন্দিতে। ‘লেথাল উইপন’ ব্যবহারের নির্দেশ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এসেছে এ স্বীকারোক্তি বিচারকদের চোখে শীর্ষ নির্দেশের সুস্পষ্ট প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

জুলাই সহিংসতা নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদন, ফোনালাপের রেকর্ড, ঘটনাস্থলের ভিডিও এবং ৫৪ জন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য এসব মিলেই প্রসিকিউশনের মামলা শক্তিশালী হয়।

প্রসিকিউটরদের দাবি এ সাক্ষ্যপ্রমাণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ডেও টিকে থাকবে। তবে রাজনৈতিক মহলের একটি অংশ এটিকে ‘বিচারকে রাজনৈতিক প্রতিশোধে ব্যবহারের উদাহরণ’ বলে প্রশ্ন তুলেছে। অন্যদিকে ভুক্তভোগী পরিবার, নাগরিক সমাজের একাংশ এবং জুলাই আন্দোলনের সংগঠকরা বলছেন, এটি “রাষ্ট্রীয় দায়মুক্তির অবসান”।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া: উল্লাস ও উদ্বেগের দ্বৈত চিত্র

রায় ঘোষণার পর ঢাবি, টিএসসি, শাহবাগ ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসজুড়ে উল্লাস একটি রাজনৈতিক যুগের অবসানের প্রতীক যেন। বিএনপি ও জাতীয় নাগরিক পার্টির বিবৃতি থেকে পরিষ্কার তারা এই রায়কে রাজনৈতিক পুনর্সাম্যের সুযোগ হিসেবে দেখছে।

অন্যদিকে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এই রায়কে “সাজানো” বলা হলেও কোনো সংগঠিত প্রতিরোধ দেখা যাচ্ছে না। দলটির কেন্দ্রীয় কাঠামো ধ্বসে পড়া, নেতাকর্মীদের ছড়িয়ে পড়া এবং নেতৃত্বের ভার্চ্যুয়াল উপস্থিতি এসবই তাদের রাজনৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করেছে।

ভারতের ভূমিকা: রায়ে নতুন ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েন

সবচেয়ে সংবেদনশীল প্রশ্ন ভারত কি শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত দেবে?

প্রত্যর্পণ চুক্তি থাকলেও ভারত এখনো সাড়া দেয়নি। বিশ্লেষকদের মতে, ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের দীর্ঘ রাজনৈতিক বিনিয়োগ, নিরাপত্তা সহযোগিতা এবং আঞ্চলিক স্থিতি সবই এই সিদ্ধান্তকে জটিল করেছে। বাংলাদেশ সরকারের কঠোর অবস্থান “আশ্রয় দেওয়া হবে অবন্ধুসুলভ আচরণ” সম্পর্কে নতুন চাপের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

যদি ভারত তাঁকে ফেরত না দেয়, তবে রায় কার্যকর হবে না; আর ফেরত দিলে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এক নতুন নজির সৃষ্টি হবে।

রায়ের গভীর তাৎপর্য: রাষ্ট্রীয় সহিংসতার প্রশ্নে এক নতুন দৃষ্টান্ত

এই রায় কেবল ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাস্তি নয়—এটি প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর শীর্ষপর্যায়ের ‘কম্যান্ড রেসপনসিবিলিটি’-কে প্রথমবার স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছে। অর্থাৎ—

শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশ

নিরাপত্তা বাহিনীর বাস্তবায়ন

রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দায়

এসবের একটি সার্বিক সম্পর্ক আদালত বিচার করেছে। অতীতে রাষ্ট্রীয় সহিংসতার ঘটনাগুলো কখনো বিচারিক প্রক্রিয়ায় পৌঁছায়নি। এই রায় তাই ভবিষ্যতে ক্ষমতায় থাকা যেকোনো রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য সতর্কবার্তা।

রায়ের পর বাস্তবতা: উত্তেজনা, নিরাপত্তা এবং সম্ভাব্য অনিশ্চয়তা

অন্তর্র্বতী সরকারের সতর্কবার্তা কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা দমন করা হবে সরকারের নিরাপত্তানীতির কঠোরতা নির্দেশ করে। ধানমন্ডি৩২ এ লোকজনের ঢোকার চেষ্টা, বিশ্ববিদ্যালয়মুখী ছাত্র আন্দোলনের উচ্ছ্বাস এবং অনলাইনে হুমকি উস্কানির প্রচার সবই দেখাচ্ছে যে সমাজ রাজনৈতিকভাবে উত্তপ্ত থাকলেও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ হারাতে চাইছে না।

ভবিষ্যতে কী?

এই রায় দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের রাজনীতিকে তিনভাবে প্রভাবিত করতে পারে

১. রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাস

জুলাই অভ্যুত্থানের পর নতুন শক্তির উত্থান, বিএনপির পুনর্গঠন এবং আওয়ামী লীগের প্রাতিষ্ঠানিক সংকট রাজনৈতিক মানচিত্রকে নতুনভাবে সাজাচ্ছে।

রাষ্ট্র নাগরিক সম্পর্কের পুনঃসংজ্ঞা

গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের ন্যায়বিচার একটি প্রজন্মের রাজনৈতিক চেতনা পুনর্গঠন করছে।

আঞ্চলিক ভূরাজনীতি

ভারতের সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে রায়ের বাস্তব প্রয়োগ কতটা সম্ভব হবে।

জুলাই হত্যাকাণ্ডের রায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ইতিহাসে শুধু একটি বিচার নয় এটি ক্ষমতা, জবাবদিহি, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং গণআকাঙ্ক্ষার এক জটিল সমীকরণের বহিঃপ্রকাশ। শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড তাই কেবল একজন নেতার পরিণতি নয়; এটি এক রাজনৈতিক যুগের সমাপ্তি এবং অন্য এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সূচনা।






আর্কাইভ