শিরোনাম:
ঢাকা, সোমবার, ৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৯ কার্তিক ১৪৩২
Swadeshvumi
রবিবার ● ২ নভেম্বর ২০২৫
প্রচ্ছদ » ইসি ও নির্বাচন » জোটের ভোটে প্রতীক নিয়ে বিতর্কে বিএনপি-জামায়াত
প্রচ্ছদ » ইসি ও নির্বাচন » জোটের ভোটে প্রতীক নিয়ে বিতর্কে বিএনপি-জামায়াত
৩ বার পঠিত
রবিবার ● ২ নভেম্বর ২০২৫
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

জোটের ভোটে প্রতীক নিয়ে বিতর্কে বিএনপি-জামায়াত

শায়লা পারভীন 

---

সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) এর ২০ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, এখন থেকে জোট করলেও প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে নিজস্ব প্রতীকে ভোটে অংশ নিতে হবে। আগে জোটভুক্ত ছোট দলগুলো বড় দলের প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিতে পারত। এই নতুন বিধান বাতিল করে আগের নিয়ম বহালের দাবি তুলেছে বিএনপি। তাদের অভিযোগ এই বিধান বহাল থাকলে প্রতীক বেছে নেওয়ার গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হবে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী স্পষ্টভাবে বলেছে নিজস্ব প্রতীকে ভোটের এই বাধ্যবাধকতা সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত; এটি বাতিল করা হলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ভেঙে পড়বে।

আরপিও সংশোধনে নতুন বিতর্ক

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার সম্প্রতি জাতীয় নির্বাচন সংক্রান্ত আইন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করেছে।

উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদিত এই সংশোধনী এখন রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের অপেক্ষায়। কার্যকর হলে, রাজনৈতিক জোটভুক্ত কোনো দল আর অন্য দলের প্রতীকে ভোট করতে পারবে না—প্রত্যেককেই নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে।

দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত ‘জোটীয় প্রতীক’-ভিত্তিক নির্বাচনী ব্যবস্থার অবসান ঘটানোর এই পদক্ষেপই বর্তমানে দেশের রাজনীতিতে তীব্র আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

বিএনপির আপত্তি: “গণতান্ত্রিক অধিকার খর্বের প্রয়াস”

২৬ অক্টোবর রাজধানীর আগারগাঁওয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীনের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল আনুষ্ঠানিকভাবে সংশোধনীর বিরুদ্ধে আপত্তি জানায়।

বৈঠক শেষে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাঈল জবিউল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন— “বিএনপি এই সংশোধনের সঙ্গে একমত নয়। এটি জোট রাজনীতির গণতান্ত্রিক চর্চা ধ্বংস করবে। অতীতে জোটভুক্ত দলগুলো একে অপরের প্রতীকে প্রার্থী দিয়েছে, এতে কখনো জটিলতা হয়নি।”

বিএনপি দাবি করছে, আগের নিয়মে ভোট দিলে ছোট দলগুলো বড় দলের প্রতীকের সুবিধা পেত, ফলে জোটের ভোট এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত হতো।

নতুন বিধানে সেই কাঠামো ভেঙে পড়বে, যা জোটভিত্তিক রাজনীতির ভিত্তিকেই দুর্বল করবে। তাদের মতে, এই সংশোধন ভোটের কৌশলগত ঐক্য নষ্ট করে সরকারবিরোধী জোটগুলোকেই দুর্বল করতে উদ্যত হয়েছে।

জামায়াতের পাল্টা অবস্থান: ‘বাতিল হলে সমতার পরিবেশ নষ্ট হবে’

অন্যদিকে, ২৮ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে জামায়াতে ইসলামী এই সংশোধনের পক্ষে অবস্থান স্পষ্ট করেছে। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন— ‘প্রত্যেক দল নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেবে—এটাই স্বচ্ছ নির্বাচনের নীতি। এই বিধান বাতিল করা হলে সেটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ভঙ্গের নগ্ন উদাহরণ হবে।’

জামায়াত মনে করে, প্রতীকভিত্তিক স্বতন্ত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাই ভোটারদের কাছে দলীয় অবস্থান পরিষ্কার করে তোলে। তারা আরও বলেছে, পূর্বের বিধান বহাল রাখলে বড় দলগুলোর প্রতীকের প্রভাব ছোট দলগুলোকে ‘ছায়ানির্ভর রাজনীতির’ মধ্যে ফেলে দিত—যা দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক বহুমতের ক্ষতি করে।

একই বৈঠকে জামায়াত ১৮ দফা দাবি জমা দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে

সিসি ক্যামেরা স্থাপন, সামরিক বাহিনীর নিয়োগ, প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব না দেওয়া, প্রবাসী ভোটারদের অংশগ্রহণের সুযোগ এবং প্রশাসনের পূর্ণ নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা।

জোট রাজনীতির কাঠামোতে সম্ভাব্য প্রভাব

বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে জোট এবং প্রতীক পরস্পর নির্ভরশীল দুটি উপাদান। ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি–জামায়াত জোট একক প্রতীক ‘ধানের শীষ’ ব্যবহার করে ব্যাপক ভোট সমন্বয় করেছিল। নতুন সংশোধনী কার্যকর হলে সেই অভ্যস্ত কাঠামো আর থাকবে না—প্রত্যেক দলকে নিজের প্রতীকের ওপর নির্ভর করতে হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বড় দলগুলো এতে তুলনামূলক সুবিধা পাবে, কারণ তাদের প্রতীক আগে থেকেই পরিচিত ও গ্রহণযোগ্য।

কিন্তু ছোট দলগুলোর পক্ষে ভোটার টানাটানি কঠিন হয়ে পড়বে।

অন্যদিকে, প্রশাসনিকভাবে এই পরিবর্তন ব্যালট প্রিন্টিং ও ফলাফল ঘোষণায় স্বচ্ছতা বাড়াতে পারে, কারণ জোটভিত্তিক প্রতীকের জটিলতা থাকবে না।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব ড. রফিকুল ইসলাম মনে করেন, সংশোধনটি শুধু আইন পরিবর্তন নয়, বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতির কাঠামোগত রূপান্তর। তার ভাষায়— ‘বাংলাদেশে জোট রাজনীতি ছিল ভোটকেন্দ্রিক শক্তি সংহতির একটি কার্যকর মাধ্যম। প্রতীকভিত্তিক এই পরিবর্তন দলগুলোর আত্মনির্ভরতা বাড়ালেও, একীভূত আন্দোলন বা জোটবদ্ধ প্রচারণার গতি কমিয়ে দিতে পারে।”

তিনি আরও বলেন ‘বিএনপি এই পরিবর্তনকে রাজনৈতিক কৌশল সীমাবদ্ধতার আশঙ্কা হিসেবে দেখছে, আর জামায়াত দেখছে সুযোগের সমতা হিসেবে। বাস্তবে উভয় ব্যাখ্যায়ই সত্যতা আছে। তবে এই পরিবর্তনের সুফল নির্ভর করবে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা ও বাস্তবায়ন কাঠামোর ওপর।’

আরপিওর ২০ নম্বর অনুচ্ছেদকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও জামায়াতের বিপরীত অবস্থান এখন জোট রাজনীতির অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন স্পষ্ট করছে। বিএনপি যেখানে বলছে এটি জোটীয় ঐক্য ভাঙবে, জামায়াত সেখানে বলছে এটি সমান প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভিত্তি গড়ে দেবে। রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর অধ্যাদেশটি কার্যকর হলে বাংলাদেশে জোটভিত্তিক নির্বাচনের ইতিহাসে এটি হবে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন—যা কেবল আইন নয়, রাজনৈতিক সমীকরণ, ভোটার আচরণ ও দলীয় কৌশল—সবকিছুকেই নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করবে।






আর্কাইভ