বৃহস্পতিবার ● ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫
প্রচ্ছদ » ইসি ও নির্বাচন » গুপ্ত হামলার আতঙ্কে প্রার্থী ও ইসির কর্মকর্তারা
গুপ্ত হামলার আতঙ্কে প্রার্থী ও ইসির কর্মকর্তারা
শায়লা শবনম
একসঙ্গে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণার পরপরই দেশের নির্বাচনকেন্দ্রিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগে পড়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তফসিল ঘোষণার ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই রাজধানী ঢাকার একটি আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণ এবং একই রাতে দুই জেলায় নির্বাচন অফিসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা নির্বাচনকে ঘিরে নিরাপত্তা শঙ্কাকে আরও প্রকট করে তুলেছে। এসব ঘটনায় শুধু প্রার্থী নয়, নির্বাচন কর্মকর্তা ও সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে।
তফসিলের পরদিন সম্ভাব্য প্রার্থী হাদির ওপর হামলা, ২ জেলায় নির্বাচন অফিসে আগুন
নিরাপত্তা চেয়ে ইসিতে আবেদন করছেন প্রার্থীরা
১৩টি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতে ইসির নির্দেশ, রিটার্নিং অফিসার ও অনুসন্ধান কমিটিকে বিশেষ নিরাপত্তা
ভোটের মাঠে ৫ দিন থাকবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, ইসির প্রস্তাব ছিল ৮ দিন
অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসী ধরতে বিশেষ অভিযান, সার্বক্ষণিক আন্তঃসমন্বয়ের তাগিদ
দেশব্যাপী নিরাপত্তার ভার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের, উদ্বিগ্ন না হতে দেশবাসীর প্রতি ইসির আহ্বান
নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের প্রতিফলন হিসেবে ইতোমধ্যে একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী নির্বাচন কমিশনের কাছে লিখিতভাবে নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করেছেন। পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে প্রার্থীদের শক্তি প্রদর্শন, পাল্টাপাল্টি অভিযোগ এবং রাজনৈতিক উত্তেজনার চিত্রও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। নির্বাচন ঘিরে এমন পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোট আয়োজন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তফসিল ঘোষণার পর ঘটনাপ্রবাহ
গত ১১ ডিসেম্বর তফসিল ঘোষণার পরদিনই ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হন। ঘটনার সময় তিনি রাজধানীর একটি এলাকায় অবস্থান করছিলেন। ওই রাতেই লক্ষ্মীপুর জেলা নির্বাচন অফিস এবং পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এর আগে টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলা নির্বাচন অফিসে হামলা এবং আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাও নির্বাচনি প্রশাসনের মধ্যে ভীতির পরিবেশ তৈরি করে।
ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, রাজনৈতিক উত্তেজনার পাশাপাশি ‘মব কালচার’ এবং অবৈধ অস্ত্রের বিস্তার মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বড় ঝুঁকি হয়ে উঠছে। তফসিল ঘোষণার পরপরই এমন ধারাবাহিক ঘটনার কারণে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ও নাশকতার আশঙ্কা নতুন মাত্রা পেয়েছে।
নিরাপত্তা চেয়ে সম্ভাব্য প্রার্থীদের আবেদন
নির্বাচনকেন্দ্রিক কর্মসূচিকে ঘিরে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ তুলে নিরাপত্তা চেয়ে নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছেন অন্তত দুই সম্ভাব্য প্রার্থী। তাদের একজন আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ–মুলাদী) আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী আসাদুজ্জামান ফুয়াদ। অপরজন কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী কাজী রেহা কবির সিগমা।
আবেদনকারীরা অভিযোগ করেন, একটি মহল পরিকল্পিতভাবে তাদের নির্বাচনি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। এতে নিজেদের ও কর্মীদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। এসব আবেদন পাওয়ার পর ইসি বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার। তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন পাওয়া মানেই আমরা বিষয়টি হালকাভাবে নিচ্ছি— তা নয়। প্রতিটি আবেদন যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
নির্বাচন অফিস ও কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা
তফসিল ঘোষণার পর দেশের সব আঞ্চলিক, জেলা, উপজেলা ও থানা নির্বাচন অফিসের নিরাপত্তা জোরদারে আইজিপিসহ সংশ্লিষ্টদের চিঠি দিয়েছে ইসি। নির্বাচনী মালামাল, গুরুত্বপূর্ণ নথি ও সংবেদনশীল তথ্য রক্ষায় এসব কার্যালয়ে পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ইসি সূত্র জানায়, ৬৯ জন রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং ৫ শতাধিক সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনার রিটার্নিং অফিসারদের জন্য গানম্যান নিয়োগ করা হয়েছে এবং অন্য এলাকাগুলোতে বাড়ানো হয়েছে পুলিশি নজরদারি।
ইসি ভবন ও কমিশনারদের নিরাপত্তা
সাম্প্রতিক হামলার ঘটনার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার, চার নির্বাচন কমিশনার এবং ইসি সচিবের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাও জোরদার করা হয়েছে। কমিশনারদের বাসভবন, অফিসে যাতায়াত এবং আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে অতিরিক্ত পুলিশি পাহারা ও এসকর্ট নিশ্চিত করতে ডিএমপি কমিশনারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীর ওপর হামলার পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, ‘তফসিল ঘোষণার পরদিন এমন ঘটনা আমার কাছে বজ্রপাতের মতো মনে হয়েছে।’ তার এই বক্তব্য নির্বাচন পরিস্থিতির গুরুত্ব ও উদ্বেগকেই প্রতিফলিত করে।
ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা পরিকল্পনা
পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছে, আসন্ন নির্বাচনে ৮ হাজার ২২৬টি ভোটকেন্দ্রকে ‘অধিক ঝুঁকিপূর্ণ’ এবং ২০ হাজার ৪৩৭টি কেন্দ্রকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইসি এসব কেন্দ্রকে ‘গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র’ হিসেবে বিবেচনা করছে।
ভোটের দিন এসব কেন্দ্রে অতিরিক্ত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে সিসিটিভি ও আইপি-এনাবলড বডি ক্যামেরার লাইভ ফিড নির্বাচন কমিশনের মনিটরিং সেলে দেখার ব্যবস্থাও রাখা হচ্ছে। ভোটের আগে চার দিন, ভোটের দিন এবং ভোটের পর দুই দিন—মোট সাত দিন পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা ব্যবস্থা কার্যকর থাকবে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি ইসির নির্দেশনা
নির্বাচন কমিশন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৩টি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাহিনীগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, চিহ্নিত সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার, গুজব ও অপতথ্য নিয়ন্ত্রণ, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা এবং নির্বাচনী অনুসন্ধান ও বিচারিক কমিটিকে পুলিশি সহায়তা দেওয়া।
ইসি জানিয়েছে, দেশব্যাপী নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। কমিশনে গঠিত বিশেষ মনিটরিং সেল সার্বক্ষণিকভাবে মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ না করতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘উদ্ভূত যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত। বিশেষ অভিযান ও বাহিনীগুলোর মধ্যে সার্বক্ষণিক আন্তঃসমন্বয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
ইসির ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ২৯ ডিসেম্বর। প্রতীক বরাদ্দ হবে ২১ জানুয়ারি এবং ২২ জানুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৭টা পর্যন্ত চলবে প্রচারণা। ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে ১২ ফেব্রুয়ারি।
তবে তফসিল ঘোষণার পরের ঘটনাপ্রবাহ স্পষ্ট করে দিচ্ছে— এই নির্বাচন শুধু রাজনৈতিক প্রতিযোগিতাই নয়, আইন-শৃঙ্খলার দিক থেকেও হতে যাচ্ছে এক বড় পরীক্ষা।





জাতীয় নির্বাচন: ইসির কাছে নিরাপত্তা চাইলেন দুই প্রার্থী
প্রার্থীদের অস্ত্র দেওয়ার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি: ইসি সচিব
নির্বাচন দেখতে এবার ইইউ থেকে আসছেন প্রায় ২০০ পর্যবেক্ষক
‘ডামি’ নির্বাচনের প্রার্থীদের ভোটে আসতে দেবেন না: ইসিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
গণমাধ্যমে সব প্রার্থীকে সমান সুযোগ দিতে ইসির নির্দেশ
বিজয় দিবসে সাভারের স্মৃতিসৌধে সিইসি ও কমিশনারদের শ্রদ্ধা
গণভোটের ব্যালটের ‘হ্যাঁ’/‘না’ ঘরের পাশে টিক বা ক্রস চিহ্ন দিতে হবে
স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থন তালিকা দৈবচয়ন পদ্ধতিতে যাচাই করবে ইসি 
