শিরোনাম:
ঢাকা, শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩২
Swadeshvumi
শনিবার ● ২২ নভেম্বর ২০২৫
প্রচ্ছদ » ইসি ও নির্বাচন » কেমন গেলো নাসির কমিশনের এক বছর?
প্রচ্ছদ » ইসি ও নির্বাচন » কেমন গেলো নাসির কমিশনের এক বছর?
৬ বার পঠিত
শনিবার ● ২২ নভেম্বর ২০২৫
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

কেমন গেলো নাসির কমিশনের এক বছর?

শায়লা শবনম

---

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দায়িত্ব গ্রহণের পর এক বছর পূর্ণ করেছে এ এম এম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কমিশন। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং একই সঙ্গে গণভোট আয়োজনের চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব সামনে রেখে কমিশনের ৩৬৫ দিনের এই যাত্রাপথ কেমন ছিল, সামনে তারা কেমন করবে সেসব দিকেই এখন দৃষ্টি সবার। বছরব্যাপী নির্বাচন প্রস্তুতির শেষ ধাপে গত ১৯ নভেম্বর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শেষ করেছে। এ পর্যায়ে চলছে ইসির নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত কমিশন।

গত বছরের ২১ নভেম্বর গঠিত হয় সিইসি নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন ৫ সদস্যের এই কমিশন। বিগত এক বছরে তারা- ভোটার তালিকা হালনাগাদ, সংসদীয় আসনের সীমানা চূড়ান্তকরণ, আচরণবিধি প্রণয়ন, পোস্টাল ভোটিং চালুসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ করেছে। অন্তর্র্বতী সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোট এবং ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে ইসির তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতিও প্রায় শেষ। তবে গণভোটের চূড়ান্ত কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণে এখনো সরকারের নির্দেশনা ও গণভোট আইন/অধ্যাদেশের অপেক্ষায় আছে সংস্থাটি।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রযুক্তিগত ও লজিস্টিক প্রস্তুতিতে কমিশন যথেষ্ট সক্রিয়; কিন্তু গণভোট যুক্ত হয়ে যাওয়ায় তাদের স্বাভাবিক প্রস্তুতির কাঠামো এখন প্রায় দ্বিগুণ চাপের মুখে পড়েছে।

এক দিনে দুই ভোট, সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জের

বাংলাদেশের নির্বাচন ইতিহাসে এবারই প্রথম একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং গণভোট আয়োজন করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এমন কঠিন বাস্তবতায় দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পূর্ণ করলেও সামনে যে জটিলতা ও পরিধি এই কমিশনের আগের সব অভিজ্ঞতাকে ছাড়িয়ে গেছে।

কারণ, একই দিনে দুই ধরনের ভোট মানে দ্বিগুণ ব্যালট, দ্বিগুণ প্রশাসনিক প্রস্তুতি, দ্বিগুণ পর্যবেক্ষণ কিন্তু সময় ও সম্পদের চাপ হবে এক দিনের। সেই চাপ কীভাবে সামাল দেবে নাসির কমিশন এটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

এই কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর এবারই প্রথম গেলো এক বছরে তিনবার ভোটার তালিকা হালনাগাদ করেছে। এছাড়া ভোট কেন্দ্রের তালিকা যাচাই, সীমানা পুনর্র্নিধারণ, আচরণবিধি সংশোধন এবং পোস্টাল ভোট ব্যবস্থা সম্প্রসারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পন্ন করেছে। এসব কাজ সাধারণত এক নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট ধরা হয়। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। গণভোটের অধ্যাদেশ এখনো জারি হয়নি, অথচ ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন এবং গণভোট দুটোই একসঙ্গে করার পরিকল্পনা। প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি এমন একটি প্রস্তুতি যার অনুশীলন বাংলাদেশের কোনো কমিশনেরই নেই।

সংসদ ভোটের সঙ্গে গণভোটের জন্য আলাদা রঙের ব্যালটপত্র, আলাদা গণনা শিট, আলাদা সিল, আলাদা ব্যালট বাক্স রাখতে হবে। একজন ভোটার যখন কেন্দ্রে যাবে, তাকে দুটো লাইনে দাঁড়াতে হবে বা একই বুথে দুটো ব্যালট দিতে হবে— এই প্রক্রিয়াটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রিজাইডিং অফিসারদের আলাদা নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণ দরকার।

অধ্যাদেশ জারি না হওয়ায় এখনো গণভোটের ব্যালট নকশা, প্রশ্নের ফরম্যাট, গণনা ম্যানুয়াল এসব কিছুই চূড়ান্ত করা যায়নি। ফলে চালু কাজের পাশাপাশি ‘অতিরিক্ত প্রস্তুতি’ যুক্ত হয়েছে; আর সেটা কোনো রুটিন ইভেন্টের মতো নয়।

ইসির কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘একই দিনে সংসদ নির্বাচন আর গণভোট এটা শুধু দুটো ভোট নয়; এটা দুটো প্রশাসনিক কাঠামো পাশাপাশি দাঁড় করানোর মতো ব্যাপার। সব দিক বিবেচনা করেই আমরা প্রস্ততি নিচ্ছি। জনগণকে দেওয়া ওয়াদা পূরণে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করাই আমাদের লক্ষ্য।’

এদিকে, গত ১৩ থেকে ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত চলা সংলাপে ইসি জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটের প্রস্তুতি তুলে ধরলেও সব রাজনৈতিক দল প্রক্রিয়াটিকে আস্থার জায়গা হিসেবে দেখেনি। ৫৫ দলের মধ্যে জাতীয় পার্টিসহ ৭টি দলকে সংলাপে না ডাকা কমিশনের অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আরও বড় প্রশ্ন সংলাপ শেষ হওয়ার পরও গণভোটের কাঠামো কী হবে, তা দলগুলো জানে না। ফলে জাতীয় নির্বাচনের মতোই গণভোট–সংক্রান্ত বিধিবিধান নিয়েও বিভ্রান্তি রয়ে গেছে।

ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ জেসমিন টুলী বলেন, ‘দুটি বড় নির্বাচন এক দিনে এটা যে শুধুই কারিগরি চ্যালেঞ্জ তা নয়; রাজনৈতিক আস্থার ওপরও এর প্রভাব পড়বে। দলগুলো যে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করেছে, সেই নির্বাচনই দুই ভাগে বিভক্ত এটা আগে কখনো হয়নি। এমন পরিস্থিতি দলগুলোর জন্যও নতুন, চ্যালেঞ্জিং।’

আচরণবিধি সংশোধন এবং আরপিও পরিবর্তন উভয়ই নভেম্বরের প্রথমার্ধে চূড়ান্ত করা হয়েছে। দলগুলো অভিযোগ করছে গণভোট যুক্ত করার মতো বড় কাঠামোগত পরিবর্তন সামনে রেখে এ ধরনের বিধি সংশোধন খুব কম সময় দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে সম্প্রতি ইসি সচিব আখতার আহমেদ বলেছেন, ‘সকল মতামত বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে।’ কিন্তু গণভোটের নিয়ম, ব্যালট ডিজাইন, গণনার পদ্ধতি এসব বিষয়ে এখনো কোনো বিশদ ঘোষণা নেই।

নজরদারির জন্য কি আলাদা পর্যবেক্ষক নিয়োগ হবে? নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কি আলাদা নির্দেশনা থাকবে? গণভোট সংক্রান্ত প্রচারণার আলাদা বিধি কি থাকবে?

গণভোটের ফল এক্সিট পোলনির্ভর নয়। ফলে প্রতিটি কেন্দ্রের গণনা আলাদাভাবে করতে হবে। অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচনের ফল প্রকাশেও সময় লাগে। এখন প্রশ্ন একরাতে কি দুই ফল একসঙ্গে ঘোষণা সম্ভব? যদি সম্ভব না হয়, তাহলে কোনটি আগে হবে?

এই ক্রমবিন্যাসের ওপরও রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি হতে পারে।

সিইসি নাসির উদ্দিন বলেছেন, ‘অধ্যাদেশ প্রকাশ হলেই আমরা দুই নির্বাচন আলাদা লজিস্টিকে কীভাবে সামলাব তা ঘোষণা করব।’

কিন্তু সময় এখন খুবই কম। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই তফসিল; ফেব্রুয়ারিতে ভোট।

সিইসি নাসির উদ্দিন সম্প্রতি বলেছেন, ‘আমরা রেফারি হব, রাজনীতিদিদরা হলো আসল খেলোয়াড়। আমরা সব গর্ত বন্ধ করব।’ কিন্তু এবারের নির্বাচন–গণভোট মডেল রেফারির কাজকে আরও কঠিন করে দিয়েছে।

কারণ দুটি ভোট, দুটি ব্যালট, দুটি গণনা, দুটো আইনি কাঠামো এবং একই দিনে ফল প্রকাশ এই সমন্বয় সফল হলে সেটিই হবে এই কমিশনের সবচেয়ে বড় সাফল্য। অন্যদিকে সামান্য সমন্বয়হীনতাও জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট—দুটোকেই বিতর্কে ফেলতে পারে।

নাসির কমিশনের প্রথম বছর ছিল কাঠামোগত প্রস্তুতির। কিন্তু দ্বিতীয় বছর হবে বাস্তব প্রয়োগের—আর সেই প্রয়োগ এবার দ্বিগুণ জটিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন—এই চ্যালেঞ্জই নির্ধারণ করবে কমিশনের সক্ষমতা, আস্থা, গ্রহণযোগ্যতা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ভবিষ্যৎ পথচলা।






আর্কাইভ