শিরোনাম:
ঢাকা, শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩২
Swadeshvumi
বৃহস্পতিবার ● ২০ নভেম্বর ২০২৫
প্রচ্ছদ » ইসি ও নির্বাচন » ইসির গণভোট প্রস্তুতি কীভাবে এগুচ্ছে?
প্রচ্ছদ » ইসি ও নির্বাচন » ইসির গণভোট প্রস্তুতি কীভাবে এগুচ্ছে?
৮ বার পঠিত
বৃহস্পতিবার ● ২০ নভেম্বর ২০২৫
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

ইসির গণভোট প্রস্তুতি কীভাবে এগুচ্ছে?

শায়লা শবনম

দেশের ইতিহাসে প্রথমবার জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট একই দিনে আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্র্বতী সরকার। ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে এই ভোটকে সামনে রেখে এরই মধ্যে বেশিরভাগ প্রস্তুতি শেষ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়। তবে গণভোটের চূড়ান্ত কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণে সংস্থাটি এখনো সরকারের নির্দেশনা ও গণভোট আইন/অধ্যাদেশের অপেক্ষায় আছে। একই দিনে একসঙ্গে দুই ধরনের ভোট আয়োজন করা নিয়ে ইসি-সরকারি দপ্তরগুলোর মধ্যে কাজের সমন্বয়ে অনিশ্চয়তা, প্রশাসনের ওপর দলগুলোর আস্থাহীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এছাড়া গণভোট প্রশ্নের জনসাধারণের বোধগম্যতা, ব্যালট পেপার, বুথ সংখ্যা, প্রবাসী ভোট, আইনি কাঠামোসহ নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ এখন ইসির সামনে।

আইনি নির্দেশনা অপেক্ষা, প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে ইসি

সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন সম্প্রতি বলেছেন, ‘অধ্যাদেশ ছাড়া আমাদের কোনো কিছু বলা বা শুরু করার সুযোগ নেই। নির্দেশনা পেলেই পরিকল্পনা জানাবো।’  ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেছেন- ‘গণভোট পরিচালনা সম্পূর্ণ আলাদা প্রক্রিয়া। ব্যালটের ধরন, ভোটগণনা, ফলাফল ঘোষণার ভাষ্য সবই নির্বাচনের নিয়মের বাইরে। এছাড়া গণভোটের নিজস্ব কোনো আইনই এখন কার্যকর নেই। তারপরও আমরা প্রাথমিক প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছি। এরপর গণভোট অনুষ্ঠানে সরকারি অধ্যাদেশ পেলে বাকি প্রস্তুতিও দ্রুত শেষ করার আশা রাখছি।

ইসির উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হাইকোর্টের রায়ে ১৫তম সংশোধনী বাতিল হয়ে সংবিধানের পুরোনো গণভোট বিধান ফেরত এলেও কার্যকর আইন নেই; ১৯৯১ সালের গণভোট আইনও বাতিল হয়ে গেছে। নির্বাচন সামনে রেখে তাদের প্রস্তুতি অনেক এগিয়েছে, কিন্তু একই দিনে গণভোট যুক্ত হওয়ায় পুরো পরিকল্পনার কাঠামোই বদলাতে হবে। কাজেই নতুন আইন বা অধ্যাদেশ ছাড়া ইসির পক্ষে মাঠপর্যায়ের পুরো প্রস্তুতি শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না।

ইসি-সরকার সমন্বয়ের অনিশ্চয়তা

আজ বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আইন ও বিচার উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, ৩-৪ কর্মদিবসের মধ্যেই গণভোটের আইন বা অধ্যাদেশ জারি হবে। তবে ইসির সঙ্গে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের কোন সমন্বয় বৈঠক হয়নি। শুধু মৌখিক আলোচনা হয়েছে এমনটাই নিশ্চিত করেছেন কমিশনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা। জাতীয় নির্বাচনের মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে গণভোটের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু সরকারি সিদ্ধান্তে যুক্ত হওয়ায় প্রশাসনিকভাবে বড় ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। ইসির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সবই ঝুলে আছে আইনের ওপর। আইন ছাড়া ব্যালট ছাপা থেকে শুরু করে ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ কিছুই এগোবে না।’ ফলে গণভোটের পুরো কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত করতে ইসিকে সরকারি আইনের অপেক্ষা করতেই হচ্ছে।

দুই ভোট একদিনে, লাগবে বাড়তি সরঞ্জাম

একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন মানে প্রতিটি কেন্দ্রে দুটি আলাদা ব্যালট, দুটি গণনা ব্যবস্থা, অতিরিক্ত বুথ, অতিরিক্ত কর্মকর্তা, আলাদা ব্যালট বাক্স সব মিলিয়ে দ্বিগুণ লজিস্টিক চাপ। দেশের ৪০ হাজারের বেশি কেন্দ্রের প্রত্যেকটিতে অতিরিক্ত বুথ তৈরি করতে হলে নতুন করে ভোটকক্ষ ভাড়া, আসবাবপত্র জোগাড়, কর্মী নিয়োগ সবই করতে হবে নতুন বাজেটে। ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, একই দিনে দুই ভোট নিলে ভোটগ্রহণের সময় অবশ্যই বাড়াতে হবে। গণভোটের ব্যালটের কাটাছেড়া করতে সাধারণ ভোটারের সময় আরও বেশি লাগবে। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বাড়ানো, পরিবহন, নিরাপত্তা, ব্যালট সরঞ্জাম সব ক্ষেত্রে ব্যয় বাড়বে। তবে ইসির কর্মকর্তারা বলছেন— দুই ব্যালটের আলাদা রঙে ছাপলে খরচ তেমন বাড়বে না।

প্রবাসীদের গণভোটেও লাগবে বাড়তি সময়

এবারই প্রথমবারের মতো প্রবাসী বাংলাদেশীরাও বিদেশে বসেই ভোট দিতে পারবেন। আইটি সাপোর্টেট পোস্টাল ব্যালট পদ্ধতিতে সীমিত পরিসরে জাতীয় নির্বাচনে ভোটের প্রস্তুতি নিয়েছে কমিশন। প্রবাসীদের নিবন্ধনের জন্য চালু করা হয়েছে ভোটার বিডি অ্যাপ। এই পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে গণভোট সফল করা কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে এখনো স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নেই। ইসি প্রযুক্তিগতভাবে ইতিবাচক, কারণ পোস্টাল ব্যালট অ্যাপ ইতোমধ্যেই চালু রয়েছে। কিন্তু গণভোটের ব্যালট আলাদাভাবে পাঠানো যাবে কি না, আইন কি অনুমতি দেবে এসবই এখনো সুস্পষ্ট হয়নি।

গণভোট প্রশ্নে দলগুলোর অবস্থান

সরকার সিদ্ধান্ত দিলেও রাজনৈতিক দলগুলো বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। বিএনপি রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ সংস্কার, প্রশাসনিক পরিবর্তনসহ কিছু শর্ত দিয়ে সিদ্ধান্তটির প্রতি আংশিক সমর্থন জানিয়েছে। জামায়াত বলছে, ডিসি-এসপিদের সরানো ছাড়া স্বচ্ছ ভোট সম্ভব নয়। কয়েকটি দল আগে গণভোট চাইলেও অন্যরা একই দিনে ভোট আয়োজন সমর্থন করেছে। তবে অধিকাংশ দলই বলছে গণভোটের আইন কী রূপে আসছে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

কম সময়ে চ্যালেঞ্জ আরও বাড়ছে

নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতে, জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির শেষ ধাপে গণভোট একসঙ্গে করার সিদ্ধান্ত এসেছে। ফলে এ পর্যায়ে কমিশনকে পুরো পরিকল্পনা নতুন করে সাজাতে হবে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন বিশ্লেষক জেসমিন টুলী বলেছেন, ‘দুটি বড় নির্বাচন একসাথে করা চ্যালেঞ্জিং, তবে দলে আলোচনা করে মোটামুটি সব বিষয় গুছিয়ে নেওয়া হয়েছে। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করার উপায় খুঁজে বের করাই এখন মূল লক্ষ্য। আইন ও বিধিমালা ঠিক করে তফসিল ঘোষণা করা ইসির নীতি বিষয়।’ তিনি আরও জানান, গণভোটের অধ্যাদেশ সরকার জারি করবে, প্রয়োজন হলে বিধিমালা ইসি তৈরি করবে। ভোটের ব্যালট আলাদা রঙের হবে গণভোটের রঙিন, সংসদ নির্বাচনের সাদা-কালো। সবকিছু কাগজের চাহিদার ওপর নির্ভর করবে।

---

বাংলাদেশে এর আগে ১৯৭৭, ১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালে তিনবার গণভোট হয়েছে। তবে তিনটিই ছিল রাজনৈতিক বৈধতা বা শাসনব্যবস্থা নিয়ে। এবারের গণভোটের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জনমত যাচাই। আর এই প্রথম কোনো সংসদ নির্বাচনের দিনেই গণভোট যুক্ত হচ্ছে, যা বাংলাদেশের নির্বাচনি ইতিহাসে নজিরবিহীন।

আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রধমার্ধে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশ যখন উত্তপ্ত, তখন একই দিনে গণভোট আয়োজনের সিদ্ধান্তে প্রশাসনিক ও আইনি কাঠামোতে নতুন চাপ তৈরি হয়েছে। আইন না এলে ইসি পুরো প্রস্তুতি শুরু করতে পারছে না। প্রস্তুতি না শুরু হলে একই দিনে দুটি ভোট আয়োজনও দুরূহ হয়ে পড়বে। বর্তমানে নির্বাচন কমিশন দাঁড়িয়ে আছে এক ক্রান্তিকালে আইন জারি না হওয়া পর্যন্ত তাদের হাত-পা বাঁধা। এরপর আইন জারি হলেই সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একদিনে দুই ভোট আয়োজনের কর্মযজ্ঞে ঝাপিয়ে পড়তে হবে।






আর্কাইভ