মঙ্গলবার ● ১৮ নভেম্বর ২০২৫
প্রচ্ছদ » ইসি ও নির্বাচন » জাতীয় নির্বাচন: বিদেশে বসেই ভোট দেবেন প্রবাসীরা
জাতীয় নির্বাচন: বিদেশে বসেই ভোট দেবেন প্রবাসীরা
শায়লা শবনম

আগামী ১৮ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হলো নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রস্তুত করা নতুন অ্যাপ ‘পোস্টাল ভোট বিডি’। এর মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিদেশের ঠিকানায় ডাকযোগে ব্যালট পাঠিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ পাচ্ছেন। একসময় যা ছিল শুধু দাবি ও আলোচনার বিষয় এবার তা বাস্তব রূপ পাচ্ছে। ইসির হিসাব অনুযায়ী, ডাক খরচ, নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক ব্যয়সহ প্রতি ব্যালটে সরকারের ব্যয় পড়বে প্রায় ৭০০ টাকা। সর্বোচ্চ ৫০ লাখ পোস্টাল ব্যালট ছাপানোর প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে, যার নিরাপত্তায় পুরো প্রক্রিয়া পরিচালিত হবে আর্মি প্রিন্টিং প্রেসে। নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, “এটা একেবারেই নতুন এক যাত্রা। নতুনত্ব মানে কিছু চ্যালেঞ্জ থাকবেই। আমরা নির্ভুলভাবে কাজটি করতে চাই, যাতে প্রবাসীদের ভোটাধিকার বাস্তবে রূপ পায়।”
প্রবাসী ভোটাধিকার বাস্তবায়নের পথে নতুন অধ্যায়
বাংলাদেশের এক কোটি ৩০ লাখের বেশি প্রবাসী নাগরিকের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল বিদেশে বসে ভোট দেওয়ার আইনি সুযোগ। বিভিন্ন দেশে ইলেকট্রনিক ভোটিং, দূর-দূরান্তের ডাক ভোট বা কনস্যুলার ভোটের ব্যবস্থা বহুদিন ধরেই আছে। বাংলাদেশে এই প্রক্রিয়া নানা কারিগরি সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক বিতর্ক ও আইনি কাঠামোর কারণে এতদিন বাস্তবায়িত হয়নি। অবশেষে এবার ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ইসি পরীক্ষামূলকভাবে এই ব্যবস্থাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিচ্ছে।
ইসি জানায়, শুধু বিদেশে বসবাসকারীরাই দেশে নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, প্যানেলভুক্ত কর্মকর্তা এবং কারাবন্দিরাও পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিতে পারবেন। সবার জন্যই ব্যবহৃত হবে একই অ্যাপ ‘চড়ংঃধষ ঠড়ঃব ইউ’।
অ্যাপ উদ্বোধন আজ (১৮ নভেম্বর): নিবন্ধন চলবে চার সপ্তাহ
ইসি সচিব আখতার আহমেদ জানান, অ্যাপটি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হবে ১৮ নভেম্বর। এরপর পরবর্তী চার সপ্তাহে অঞ্চলভিত্তিক ধাপে ধাপে (ফেজড) প্রবাসীদের নিবন্ধন গ্রহণ করা হবে—যেমন ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ইত্যাদি অঞ্চলভেদে আলাদা সময় জানানো হবে।
১. নিবন্ধনের জন্য যা লাগবে, ২. আন্তর্জাতিক মোবাইল নম্বর, ৩. এনআইডি, ৪. লাইভ ফেস ভেরিফিকেশন, ৫. বিদেশের ঠিকানা (যেখানে ব্যালট পাঠানো হবে), ৬. পাসপোর্ট তথ্য (ঐচ্ছিক)
জিও-লোকেশন সক্রিয় থাকার কারণে বাংলাদেশ থেকে কেউ এ অ্যাপ দিয়ে নিবন্ধন করতে পারবেন না। ইসি বলছে, “বিদেশে অবস্থান নিশ্চিত করাই এই পদ্ধতির প্রথম নিরাপত্তা বলয়।”
প্রবাসীরা কী পরিমাণ হারে নিবন্ধন করবেন সে বিষয়ে ইসি সতর্ক আশাবাদী। সাধারণত অন্য দেশগুলোতে যেখানে মাত্র ২৩% প্রবাসী পোস্টাল ভোটে অংশ নেন, বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে সেই হার কিছুটা বেশি হতে পারে বলে তারা মনে করছে।
নিবন্ধন প্রক্রিয়া: মাত্র ১০-১৫ মিনিটেই সম্পন্ন
অ্যাপটিতে ব্যবহার-বান্ধব একটি ধাপভিত্তিক প্রক্রিয়া রাখা হয়েছে, যাতে প্রযুক্তিতে অদক্ষ প্রবাসীরাও সহজে নিবন্ধন করতে পারেন।
১) অ্যাপ ইনস্টল করে ভাষা নির্বাচন
২) নিজের দেশ নির্বাচন
৩) মোবাইল নম্বর দিয়ে ওটিপি ভেরিফিকেশন
৪) পাসওয়ার্ড সেট করে লগইন
৫) লাইভ ফেস ভেরিফিকেশন
৬) এনআইডি ও পাসপোর্ট তথ্য দেওয়া
৭) বিদেশের পূর্ণ ঠিকানা সংযুক্তি
৮) এনআইডি হাতে নিয়ে সেলফি আপলোড
৯) ইসির যাচাই শেষে নিবন্ধন সম্পন্ন
ইসি সচিব বলেন, “সব মিলিয়ে ১০–১৫ মিনিটেই নিবন্ধন শেষ করা সম্ভব। প্রথমবারে কিছু লোক ঝামেলায় পড়লেও পরে এটি সহজ মনে হবে।”
প্রবাসীরা ভোট দেবেন ২০ দিন আগে
প্রবাসী ব্যালট পাঠানো ফেরত আসা মিলিয়ে ডাক বিভাগগুলোর সময়সীমা বিশ্লেষণ করে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিদেশের ভোট গ্রহণ শুরু হবে সাধারণ ভোটের প্রায় ২০ দিন আগে। ডাকপত্র এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে লাগে যেখানে ১৬-২৮ দিন। ফলে প্রবাসীদের ব্যালট সময়মতো ফেরত আনা নিশ্চিত করতে আগেভাগে ভোট গ্রহণ ছাড়া বিকল্প ছিল না।
ব্যালট ফেরত পাঠানো ও গণনা
প্রবাসী ভোটারকে অবশ্যই ভোটের অন্তত ১৭ দিন আগে ব্যালট ডাক বিভাগে জমা দিতে হবে। এর চেয়ে পরে পোস্ট করলে তা সময়মতো বাংলাদেশে পৌঁছানোর নিশ্চয়তা নেই, ফলে গণনায় ধরা হবে না। ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন ভোট গ্রহণের দিন বিকেল ৪টার পর পৌঁছানো কোনো ব্যালটই গণনায় যোগ হবে না।
ব্যালট পাঠানো ফেরত আসা: তিন খামের কাজ
ইসি ডাক বিভাগের মাধ্যমে প্রবাসী ভোটারের ঠিকানায় একটি বড় খামে (খাম ১) পাঠাবে ফেরত খাম (খাম ২), ব্যালট পেপার সম্বলিত খাম (খাম ৩), প্রয়োজনীয় ঘোষণা ও নির্দেশনাপত্র, ব্যালটে থাকবে কেবল প্রতীক। এরপর ভোটার নির্দেশনা পড়ে ব্যালটে প্রতীকের পাশে টিক/ক্রস দিয়ে, ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করে, ব্যালট ফেরত খামে ভরে, নিকটস্থ পোস্ট অফিসে জমা দেবেন, ডাক মাশুল আগেই সরকারিভাবে পরিশোধ করা থাকবে। ভোটারের কোনো খরচ নেই।
ব্যালটের নিরাপত্তায় আর্মি প্রিন্টিং প্রেস
পোস্টাল ভোটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যালট ছাপানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আর্মি প্রিন্টিং প্রেসকে। প্রাথমিকভাবে ছাপানো হবে ২০ লাখ ব্যালট, লক্ষ্য ৫০ লাখ। ইসি সানাউল্লাহ বলেছেন, ‘অনেক দেশে পোস্টাল ব্যালটের ওয়েস্টেজ রেট ২৪ শতাংশ। ঠিকানা ভুল, সময়মতো পাঠানো না এ ধরনের ঝুঁকি কমাতে নিরাপত্তা ও ট্র্যাকিংকে আমরা অগ্রাধিকার দিচ্ছি।’
প্রতি প্রবাসী ভোটে খরচ ৭০০ টাকা
প্রবাসের ডাকঘর থেকে ব্যালট পাঠানো ফেরত আসা মিলিয়ে পুরো প্রক্রিয়া ১৫-৩০ দিন সময় নিতে পারে। প্রতি ভোটের জন্য ইসির খরচ পড়বে ৭০০ টাকা। ইসির হিসাবে ৫০০ টাকা। এর সঙ্গে ডাকযোগে পাঠানো-ফেরত আনার সমন্বয়, অ্যাপ ব্যবস্থাপনা, লজিস্টিক খরচ ২০০ টাকাসহ অন্যান্য প্রশাসনিক ব্যয় মিলিয়ে মোট ৭০০ টাকা ব্যয় হবে। ইসি ইতোমধ্যে এ খাতে ৩৫০ কোটি টাকার মতো বাজেট প্রস্তাব করেছে।
ইসি সানাউল্লাহ’র ভাষায়, “গোপনীয়তা নিশ্চিত করতে যত খরচই হোক, ভোটের সঠিকতা নিশ্চিত করা জরুরি।”
দেশে পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেবেন যারা
দেশের ভেতরের বিশেষ ভোটাররাও পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেবেন। পোস্টাল ব্যালট শুধু প্রবাসীদের জন্য নয় দেশের ভেতরেও কয়েকজন শ্রেণির ভোটার এই সুবিধা পাবেন। তারা হলেন
১) নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী
২) কারাবন্দি আসামি
৩) প্যানেলভুক্ত নির্বাচন কর্মকর্তা
তাদের জন্য অ্যাপেই আলাদা অপশন থাকবে।
সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ: দুই-ই বড়
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পোস্টাল ভোট ব্যবস্থায় ঠিকানা ভুল, ব্যালট হারানো, সময়মতো পৌঁছাতে না পারা এসব কারণে গড়ে ২০-২৪% ব্যালট বাতিল হয়। বাংলাদেশও একই ঝুঁকির মুখে।
সম্ভাবনাগুলো-
প্রবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবির বাস্তবায়ন
ডিজিটাল পরিচয় ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি
ভবিষ্যতে দূরশিক্ষা, ডিজিটাল সেবা ও কনস্যুলার সুবিধায় নতুন পথ
চ্যালেঞ্জগুলো-
সময়সীমা মেনে ব্যালট ফেরত পাঠানো
বিদেশের ঠিকানা ভুল হলে ব্যালট পৌঁছবে না
শেষ মুহূর্তে আদালত বা ইসি রায়ে প্রার্থিতা পরিবর্তিত হলে পূর্বে পাঠানো সব ব্যালট বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা
ডাকবিভাগের দ্রুত সমন্বয় এবং প্রবাসীদের তথ্য-উপলব্ধতা নিশ্চিত করা
ইসি বলছে, দেশ-বিদেশের হাইকমিশন, কনস্যুলেট, কমিউনিটি সংগঠন ও বাংলা মিডিয়াকে সঙ্গে নিয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হবে।
প্রবাসীরা কী বলছেন
সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া এসব দেশে থাকা অনেক বাংলাদেশি ইতোমধ্যে সামাজিক মাধ্যমে জানিয়েছেন যে তাঁরা অ্যাপটি নিয়ে আগ্রহী। তাদের মতে, “দীর্ঘদিন বাইরে থাকলেও দেশের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাওয়া বড় বিষয়।”
তবে অনেকে আবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন
ব্যালট কি সময়মতো পৌঁছবে?
ফেরত পাঠালে মাঝপথে হারিয়ে যাবে না তো?
ভোটের গোপনীয়তা কীভাবে নিশ্চিত হবে?
ইসি বলছে, ব্যালটকে প্রতিটি ধাপে ট্র্যাক করার জন্য বিশেষ কিউআর কোড ও অনন্য রেজিস্ট্রেশন নম্বর ব্যবহার করা হবে।
ইসির আশাবাদ সতর্কতার সঙ্গে অগ্রগতি
নির্বাচন কমিশনার সানাউল্লাহ বলেন “নতুনত্ব প্রধান চ্যালেঞ্জ। টুকটাক ঝামেলা থাকতেই পারে। কিন্তু আমরা এক ধাপ এগিয়ে যাচ্ছি। ভবিষ্যতে এটি আরও সহজ, দ্রুত ও প্রযুক্তিনির্ভর হবে।”
তিনি আরও বলেন “আমাদের লক্ষ্য একজন ভোটারও যেন তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে ব্যর্থ না হন। পোস্টাল ভোট পদ্ধতি বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করবে।”
‘পোস্টাল ভোট বিডি’ অ্যাপের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি নাগরিক জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এটি কেবল একটি অ্যাপ নয় এটি গণতান্ত্রিক অন্তর্ভুক্তির এক নতুন দিগন্ত। সময়মতো ব্যালট পৌঁছানো, নিরাপত্তা রক্ষা, প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা সব চ্যালেঞ্জ পেরুতে পারলেই বাংলাদেশ নির্বাচন ব্যবস্থায় একটি বড় পরিবর্তন স্থায়ীভাবে যুক্ত হয়ে যাবে।
প্রবাসীরা এখন অপেক্ষায় ১৮ নভেম্বর অ্যাপ চালুর পর নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পথ খুলবে কি না। আর দেশের ভেতরের পর্যবেক্ষকরা তাকিয়ে আছেন ইসি এই নতুন যাত্রা কতটা সফলভাবে শেষ করতে পারে।





চালু হলো ইসির ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ অ্যাপ
স্বচ্ছ নির্বাচনে রিপোর্টারদের দক্ষতা বাড়াতে এমআরডিআই-আরএফইডি’র মধ্যে চুক্তি সই
সংসদ নির্বাচনে এবার ভোট দিতে পারবে ১২ কোটি ৭৭ লাখ
ইসির ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ অ্যাপের উদ্বোধন কাল
সহযোগিতা করলে আলহামদুলিল্লাহ, না করলে ইন্নালিল্লাহ: ইসি তাহমিদা
বুধবার ইসির সংলাপে বসবে বিএনপি ও জামায়াত
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সুন্দর দেশ গড়তে চাই: সিইসি
নির্বাচনে জাপা ও বাম দলগুলোকে বাদ না দেয়ার সুপারিশ
সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে দলগুলোর সহযোগিতা চাইলেন সিইসি 