শিরোনাম:
ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬ পৌষ ১৪৩২
Swadeshvumi
মঙ্গলবার ● ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫
প্রচ্ছদ » জাতীয় » গৃহবধূ থেকে যেভাবে দেশনেত্রী খালেদা জিয়া
প্রচ্ছদ » জাতীয় » গৃহবধূ থেকে যেভাবে দেশনেত্রী খালেদা জিয়া
২০ বার পঠিত
মঙ্গলবার ● ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

গৃহবধূ থেকে যেভাবে দেশনেত্রী খালেদা জিয়া

---

 

শায়লা শবনম

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে খালেদা জিয়া একটি ব্যতিক্রমী নাম। গৃহবধূ থেকে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, দীর্ঘ প্রায় চার দশকের রাজনীতি, আন্দোলন-সংগ্রাম, রাষ্ট্রক্ষমতা, কারাবরণ ও নিপীড়নের মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এক দৃঢ়চেতা, আপসহীন এবং শেষ পর্যন্ত ‘জাতির ঐক্যের প্রতীক’ হিসেবে।

রাজনীতিতে অনিচ্ছাকৃত প্রবেশ

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ৩০ মে নিহত হওয়ার পর দলটি নেতৃত্ব সংকটে পড়ে। সেই সংকটময় সময়ে, স্বামীর মৃত্যুর সাত মাস পর ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি খালেদা জিয়া বিএনপিতে যোগ দেন। তখন তিনি মূলত একজন গৃহবধূ। বয়সও ছিল চল্লিশের নিচে।

প্রথমে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান, পরে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং শেষ পর্যন্ত চেয়ারপারসনের দায়িত্ব নেন তিনি। নতুন নেতৃত্বে শুরু হয় বিএনপির নতুন পথচলা।

এরশাদবিরোধী আন্দোলন ও ‘আপসহীন নেত্রী’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদবিরোধী আন্দোলনই খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলে। ১৯৮৩ সালে আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ৭–দলীয় ঐক্যজোট। দীর্ঘ নয় বছরের আন্দোলনে তিনি পরিচিতি পান ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে।

১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানে এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি অভাবনীয় জনসমর্থন পেয়ে ক্ষমতায় আসে। খালেদা জিয়া হন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। পরে আরও দুই দফা তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন।

লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর ‘খালেদা’ গ্রন্থে লিখেছেন,

“বাস্তবিক অর্থে তিনি ছিলেন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী।”

নারী নেতৃত্বের এক অনন্য দৃষ্টান্ত

পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থায় মুসলিমপ্রধান একটি দেশে একজন নারীর প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠাকে ভিন্ন দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করেছেন প্রয়াত সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ। ‘বেগম খালেদা জিয়া: জীবন ও সংগ্রাম’ গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লেখেন,

“তিনি এমন এক সময়ে স্বকীয় রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করেন, যখন পুরুষ আধিপত্য ছিল প্রশ্নাতীত।”

সংলাপ, সমঝোতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা

আন্দোলনে আপসহীন হলেও রাজনৈতিক সমঝোতার প্রশ্নে খালেদা জিয়া ছিলেন বাস্তববাদী। প্রয়োজনে তিনি নিজের অবস্থান থেকেও সরে এসেছেন বৃহত্তর স্বার্থে। এর বড় উদাহরণ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, যা প্রথমে বিএনপির এজেন্ডায় না থাকলেও জনদাবির মুখে তিনি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন।

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি ৭–দলীয়, ৪–দলীয় এবং সর্বশেষ ২০–দলীয় জোটের নেতৃত্ব দিয়েছেন। সমমনা ও বিপরীত মতাদর্শের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতায় তাঁর অনীহা ছিল না—যা বাংলাদেশের জোট রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

এক-এগারো ও ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি

২০০৭ সালের এক-এগারোর পর খালেদা জিয়া ও তাঁর পরিবার ভয়াবহ দমন-পীড়নের মুখে পড়ে। গ্রেপ্তার হন তিনি ও তাঁর দুই ছেলে। তাঁকে দেশত্যাগে বাধ্য করার চেষ্টা হলেও তিনি অনড় থাকেন।

তিনি বলেছিলেন,

“এই দেশ, এই দেশের মাটি-মানুষই আমার সবকিছু। আমি দেশের বাইরে যাব না।”

পরবর্তী সময়ে ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে উচ্ছেদ, গুলশানে অবরুদ্ধ থাকা, সন্তানের মৃত্যু—সব মিলিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন হয়ে ওঠে বেদনাবহ। তবু তিনি ভেঙে পড়েননি। দেশবাসীর ওপরই আস্থা রেখেছেন।

শেষ জীবনে ‘ঐক্যের প্রতীক’

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর মুক্তি পান খালেদা জিয়া। ৭ আগস্ট নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশে দেওয়া এক সংক্ষিপ্ত ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন—

“ধ্বংস নয়, প্রতিশোধ নয়, প্রতিহিংসা নয়; ভালোবাসা, শান্তি ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলি।”

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, দীর্ঘ আন্দোলন, রাষ্ট্রক্ষমতা, কারাবরণ ও নিপীড়নের পথ পেরিয়ে খালেদা জিয়া শেষ জীবনে এসে দল-মতনির্বিশেষে এক সম্মানিত ও ঐক্যবদ্ধ প্রতীকে পরিণত হয়েছেন।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যথার্থই লিখেছেন,

“বেগম খালেদা জিয়া শুধু একজন ব্যক্তি নন, নিজ কর্মগুণে তিনি একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন।”

গৃহবধূ থেকে রাষ্ট্রনায়ক—খালেদা জিয়ার এই উত্তরণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায় হয়েই থাকবে।



বিষয়: #



আর্কাইভ