শিরোনাম:
ঢাকা, মঙ্গলবার, ২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৮ অগ্রহায়ন ১৪৩২
Swadeshvumi
মঙ্গলবার ● ২ ডিসেম্বর ২০২৫
প্রচ্ছদ » জাতীয় » পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৮ বছরেও পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি অধরা!
প্রচ্ছদ » জাতীয় » পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৮ বছরেও পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি অধরা!
২ বার পঠিত
মঙ্গলবার ● ২ ডিসেম্বর ২০২৫
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৮ বছরেও পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি অধরা!

রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তিকে একসময় ভূ-রাজনৈতিক সাফল্যের অনন্য উদাহরণ হিসেবে দেখা হয়েছিল। দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলা পাহাড়ের সশস্ত্র দ্বন্দ্ব থামাতে, সহিংসতা কমাতে এবং চিরস্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত এ চুক্তির ওপর তখন পাহাড়বাসীসহ গোটা দেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল বিপুল। কিন্তু ২৮ বছর পরও সেই প্রত্যাশার স্থায়ী শান্তি ফেরেনি বরং অনেক দিক থেকে পরিস্থিতি আরও জটিল, বিভাজন আরও গভীর, আর আস্থার সংকট আরও প্রবল।

পাহাড়ে এখন যে বাস্তবতা, তা চুক্তিকে ঘিরে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি, প্রশাসনিক ব্যর্থতা, আভ্যন্তরীণ সংঘাত ও বিভক্ত প্রতিরোধ রাজনীতির বহুমাত্রিক সংকটকে নগ্নভাবে সামনে নিয়ে আসে।

চুক্তির আগে পাহাড়ে মূলত একটি আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন সক্রিয় থাকলেও আজ সক্রিয় ছয়টি সশস্ত্র আঞ্চলিক সংগঠন।

খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে— সন্তু লারমার পিসিজেএসএস, সংস্কারপন্থি পিসিজেএসএস এমএন লারমা গ্রুপ, প্রসিত বিকাশ খীসার ইউপিডিএফ, সংস্কারপন্থি ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক।

বান্দরবানে মগ লিবারেশন পার্টি (এমএলপি), কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)।

এই ছয় সংগঠনের পারস্পরিক সংঘাত এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে প্রায় নিয়মিত বন্দুকযুদ্ধ পাহাড়ের সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাকে চরম ঝুঁকিতে ঠেলে দিয়েছে। চাঁদাবাজি, অপহরণ, গুম, খুন—সবকিছু মিলিয়ে পাহাড়ে শঙ্কা এখন নিত্যদিনের বাস্তবতা।

পাশাপাশি বাঙালি-ভিত্তিক আঞ্চলিক সংগঠনগুলো চুক্তিকে শুরু থেকেই “কালো” ও “বৈষম্যমূলক” আখ্যা দিয়ে আসছে। ফলে পাহাড় এখন বহুপাক্ষিক অবিশ্বাসের কেন্দ্রে—যেখানে শান্তিচুক্তির লক্ষ্য বরং আরও বিচ্ছিন্ন বলে মনে হচ্ছে।

চুক্তির ৭২ ধারার মধ্যে— ৪৮টি বাস্তবায়িত, ১৫টি আংশিক বাস্তবায়িত এবং ৯টি এখনো অকার্যকর।

কাগজে-কলমে অগ্রগতি থাকলেও মূল সংকট রয়ে গেছে—

> ভূমি কমিশন কার্যত অচল

> সাধারণ প্রশাসন, পুলিশ, ভূমি ব্যবস্থাপনা ও বন খাত জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর হয়নি

> তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন নেই তিন দশক

> আঞ্চলিক পরিষদ আইন পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর নয়

এ অবস্থায় পাহাড়ি সংগঠনগুলো মনে করে, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবই চুক্তি বাস্তবায়নের সবচেয়ে বড় বাধা। আবার বাঙালি সংগঠনগুলোর মতে, চুক্তির অনেক ধারাই তাদের ‘প্রান্তিক অবস্থায়’ ঠেলে দিয়েছে।

চুক্তির ২৮তম বর্ষপূর্তিতে খাগড়াছড়িতে সংবাদ সম্মেলন করে পিসিজেএসএসের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সুধাকর ত্রিপুরা বলেন- “চুক্তির ২৮ বছরে আওয়ামী লীগ ২০ বছর ক্ষমতায় ছিল। তারা চুক্তি করেছে, কিন্তু বাস্তবায়ন করেনি। জুম্ম জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।”

তাদের ৮ দফা দাবি

১. ভূমি কমিশনের বিধিমালা চূড়ান্ত করে বিচারিক কার্যক্রম শুরু

২. ১৯০০ সালের পার্বত্য শাসনবিধি বহাল

৩. সাধারণ প্রশাসন, পুলিশ, ভূমি ও উপজাতীয় আইন জেলা–আঞ্চলিক পরিষদের কাছে হস্তান্তর

৪. স্থায়ী বাসিন্দা ভিত্তিক নতুন ভোটার তালিকা

৫. তিন জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন

৬. প্রত্যাগত পিসিজেএসএস সদস্যদের পুনর্বাসন

৭. ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী পুনর্বাসন

৮. আদিবাসীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও বাস্তবায়ন রোডম্যাপ ঘোষণা

একই দাবিতে সম্প্রতি বিক্ষোভ করেছে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, যুব সমিতি ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন।

ইউপিডিএফের অভিযোগ“চুক্তি বাস্তবায়নে শক্তিশালী আন্দোলনই হয়নি”

ইউপিডিএফ মুখপাত্র অংগ্য মারমা বলেন- “চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘ আন্দোলন প্রয়োজন ছিল, সেটা হয়নি। জেএসএস আন্দোলন করলে আমরা পাশে থাকব।” ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নেতা অমর জ্যোতি চাকমা আরও বলেন— ‘মৌলবাদী গোষ্ঠীসহ কিছু আঞ্চলিক দলও বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত করেছে। অন্তর্র্বতী সরকারের কাছেও আমরা আশাহত।”

---

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ বলছে— “চুক্তি পাহাড়ি-বাঙালি বিভাজনকে প্রাতিষ্ঠানিক করেছে। চুক্তি বৈষম্যমূলক, আমাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে”। তাদের অভিযোগ— বাঙালিদের পরিচয় ‘অ-উপজাতি’ হিসেবে নির্ধারণ, শিক্ষা–চাকরিতে কোটা বৈষম্য, আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদ আইনে প্রশাসনিক ক্ষমতা খর্ব করে মেধাবী বাঙালিদের পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। “চুক্তি বৈষম্যমূলক, আমাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে”। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সম্পাদক আবদুল মজিদ বলেন, “এটি শান্তি চুক্তি নয় একটি কালো ও বৈষম্যমূলক চুক্তি।”

বিএনপির অভিযোগ “নোবেলের আশায় চুক্তি, শান্তি নয়”

খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপি সভাপতি ওয়াদুদ ভূঁইয়ার অভিযোগ আরও রাজনৈতিক—

“শেখ হাসিনা নোবেল পাওয়ার আশায় চুক্তি করেছিলেন। এতে পাহাড়ে বরং বৈষম্য, বিভেদ ও ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বেড়েছে।”

২৮ বছরের প্রতিশ্রুতির বিপরীতে কঠিন বাস্তবতা

পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতা আজ এক গভীর বিরোধের প্রতিফলন। একদিকে পাহাড়ি সংগঠনগুলোর অভিযোগ- পর্যাপ্ত রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। অন্যদিকে বাঙালি সংগঠনগুলোর অভিযোগ- চুক্তি বৈষম্য বাড়িয়েছে। আর ইউপিডিএফের অভিযোগ- আন্দোলন দুর্বল ছিল। ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পক্ষবিচ্ছিন্ন সহিংসতা ও চাঁদাবাজির বিস্তার। দীর্ঘ ২৮ বছর পর চুক্তির উদ্দেশ্য—স্থায়ী শান্তি, সমতার ভিত্তিতে প্রশাসনিক কাঠামো, ভূমি বিরোধের সমাধান, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন— সবই কার্যত অচল বাস্তবতার সামনে পড়ে আছে।

আস্থাহীনতা ও বহুপক্ষীয় দ্বন্দ্ব

পাহাড়ে শান্তিচুক্তি এ পর্যায়ে রাজনৈতিক-প্রশাসনিক প্রতিশ্রুতির পরীক্ষায় ব্যর্থ নথি হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। এর মূলে রয়েছে- পাহাড়ি বনাম পাহাড়ি দ্বন্দ্ব, পাহাড়ি বনাম বাঙালি উত্তেজনা, আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতা, রাজনৈতিক সরকারের প্রতি আস্থাহীনতা, ভূমি বিরোধের বিচারহীনতা, নির্বাচিত স্থানীয় সরকার কাঠামোর শূন্যতা।

পরিবর্তন কি আদৌ সম্ভব?

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ২৮তম বর্ষপূর্তি তাই উদযাপনের নয়— চরম আত্মসমালোচনার মুহূর্ত।

পাহাড়ের মানুষ নিরাপত্তাহীন, রাজনৈতিক দলগুলো বিভক্ত, আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘাত প্রবল, আর সরকারগুলোর প্রতিশ্রুতি আস্থা হারিয়েছে।

স্থায়ী সমাধান চাইলে ভূমি কমিশন কার্যকর করা, নির্বাচিত আঞ্চলিক প্রশাসন ফিরিয়ে আনা,

পাহাড়িু বাঙালি দুই পক্ষের উদ্বেগকে সমান গুরুত্ব দেওয়া, বহুপক্ষীয় সংলাপ করা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ— রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিশ্চিত করা। এসব নিশ্চিত করতে না পারলে পাহাড়ে শান্তি শুধু চুক্তির কাগজে লেখা শব্দ হিসেবেই থেকে যাবে বাস্তবে নয়।






আর্কাইভ