শিরোনাম:
ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ৩ অগ্রহায়ন ১৪৩২
Swadeshvumi
সোমবার ● ১৭ নভেম্বর ২০২৫
প্রচ্ছদ » প্রধান সংবাদ » পোস্টারের রাজনীতি: আচরণবিধি অমান্যের মহোৎসব
প্রচ্ছদ » প্রধান সংবাদ » পোস্টারের রাজনীতি: আচরণবিধি অমান্যের মহোৎসব
৫ বার পঠিত
সোমবার ● ১৭ নভেম্বর ২০২৫
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

পোস্টারের রাজনীতি: আচরণবিধি অমান্যের মহোৎসব

শায়লা শবনম

আচরণবিধি অমান্যের মহোৎসবে মেতে উঠেছে রাজধানী ঢাকা। শহরের মোড়, ফুটপাত, দেয়াল, গাছ, সেতুর রেলিং, এমনকি স্কুল-কলেজ থেকে মসজিদ-মন্দির কোনো স্থাপনা পোস্টারের আক্রমণ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। নগরজুড়ে এক ধরনের ‘পোস্টার মহাপ্লাবন’ তৈরি হয়েছে, যার উৎস একই আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে লাগামহীন প্রচারণা।

নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগেই রাজধানীর প্রতিটি কোণা দখল করে নিয়েছে রাজনৈতিক ব্যানার, প্যানা, পোস্টার ও ফেস্টুন। এ যেন এক পোস্টারের নগরী। নির্বাচন কমিশন (ইসি) স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও, আচরণবিধি মানার প্রশ্নে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে যেন চলছে ‘অমান্যের প্রতিযোগিতা’। যে শহর পরিচ্ছন্নতা ও আধুনিক নগরচিত্রের স্বপ্ন দেখছে, তার দেয়ালগুলো আজ আঠা-ছেঁড়া কাগজে ঢেকে কুৎসিত হয়ে উঠেছে।

 

নিষেধাজ্ঞা কাগজে, মাঠে পোস্টারের দৌরাত্ম্য

১১ নভেম্বর প্রকাশিত ‘রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণবিধিমালা ২০২৫’এ স্পষ্ট বলা আছে নির্বাচনী প্রচারণায় কোনো ধরনের পোস্টার ব্যবহার করা যাবে না। দালান, গাছ, খুঁটি, ব্রিজ, যানবাহন কোথাও লিফলেট-ব্যানার-ফেস্টুন সাঁটানো যাবে না। তবে মাঠের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। ঢাকার রাস্তায় তাকালেই মনে হবে এ যেন পোস্টারেরই নির্বাচন; প্রার্থী শুধু নামমাত্র।

সিঁদুরে মেঘ দেখেই সিইসি এএমএম নাসির উদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘এখনই পোস্টারে ছেয়ে গেছে ঢাকা শহর। নিজেরাই সরিয়ে ফেলুন না হলে বুঝে নেব নিয়ত ঠিক নেই।’ ইসির এই হুঁশিয়ারির পরও শহরে পোস্টার কমার বদলে যেন উল্টো বেড়েছে।

ঢাকা শহর: পোস্টার, আঠা আর বিশৃঙ্খলার নগরী

ঢাকার ১৮টি সংসদীয় আসনের চিত্র প্রায় একই কোথাও দেয়াল দেখা যায় না, কেবল স্তুপ হয়ে থাকা পোস্টার। মেট্রোরেলের পিলার থেকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের গার্ডার সবখানে লেখা বড় বড় অক্ষরে দলীয় পরিচয়, সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম এবং ‘দোয়া চাই’ শব্দগুলোর ছড়াছড়ি। যেসব স্থাপনায় একটি পোস্টার লাগানো আইনত নিষিদ্ধ, সেগুলোই আজ বেশি দখলে।

ফলাফল নগরীর সৌন্দর্য ধ্বংস, দেয়ালের রং নষ্ট, ড্রেনে পোস্টার জমে জলজট, ট্রাফিক সাইন ঢেকে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বৃদ্ধি, প্লাস্টিক আঠার কারণে পরিবেশ দূষণ। একদিকে সিটি করপোরেশন নিয়মিত অপসারণের কথা বললেও, পরদিনই আবার নতুন পোস্টারে দেওয়াল পূর্ণ হয়ে যায়।

ডিএনসিসির সক্রিয়তা, ডিএসসিসির নীরবতা

ডিএনসিসি প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বারবার বলছেন ‘আমরা প্রতিদিন পোস্টার ফেস্টুন অপসারণ করছি, জরিমানা করছি।’ তবে নাগরিকরা প্রশ্ন তুলছেন যদি নিয়মিত অভিযান চলে, তাহলে পোস্টারের পাহাড় বাড়ছে কীভাবে?

ডিএনসিসি ২০২৩ সালে নগরের বিভিন্ন জায়গায় ২৩টি নির্দিষ্ট পোস্টার বোর্ড বসায়, যাতে পোস্টার লাগানোর বিশেষ জায়গা সৃষ্টি হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো বোর্ডে নেই পোস্টার, বরং আশপাশের সব দেয়াল ভরে গেছে প্রচারণায়।

অন্যদিকে ডিএসসিসি পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় ময়লা রাস্তায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ যতটা চোখে পড়ে, পোস্টার অপসারণে ততটাই অনীহা। একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন ‘মেয়র নেই, প্রশাসকেরাও দায়িত্বে অনাগ্রহী সৌন্দর্য রক্ষা কারও অগ্রাধিকার নয়।’

আইন আছে, প্রয়োগ নেই দেয়াল নোংরার ‘ঐতিহ্য’

পোস্টার লাগানো নিয়ন্ত্রণে ২০১২ সালের দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো নিয়ন্ত্রণ আইন রয়েছে। কিন্তু সেই আইন যেন শুধু বইয়ে আছে; প্রয়োগ নেই।

আইনে রয়েছে অনুমতিহীন পোস্টার লাগানো যাবে না, অপরাধ করলে জেল-জরিমানা, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সংস্থাকে শনাক্ত করে মামলা, কিন্তু কখনোই কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। রাজনৈতিক চাপ, প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা, আর সিটি করপোরেশনের কাগুজে হুঁশিয়ারির কারণে আইন বাস্তবে অকার্যকর।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপার সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির বলেন, ‘পোস্টারের অপসংস্কৃতি বন্ধে রাজনৈতিক দলগুলোকেই এগোতে হবে। সিটি করপোরেশনের উচিত অপরাধীকে তাদের নাম-ঠিকানাসহ আইনের আওতায় আনা।”

নাগরিক ক্ষোভ: ‘সরকার বদলায়, অনিয়ম বদলায় না’

বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তীব্র ক্ষোভের কথা। যাত্রবাড়ির বাসিন্দা আসমা আক্তার ‘প্রতি নির্বাচনে শহরটা নোংরা হয়ে যায়। দেয়াল আমার, রং আমার কিন্তু পোস্টার লাগায় অন্যেরা।’ ফার্মগেটের ব্যবসায়ী হাসিব আল আসাদ বলেন- ‘ট্রাফিক নির্দেশনাগুলো পোস্টারে ঢেকে রাখা ভয়াবহ। দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে প্রতিনিয়ত।’ মিরপুর ১০ এলাকার বাসিন্দা সাজ্জাদ হোসেন বলেন- ‘রাতে দেয়াল রং করে সকালে দেখি পাঁচটা নতুন পোস্টার। কাউকে ধরাও যায় না।’

সিটি করপোরেশন প্রতিদিন হাজার হাজার পোস্টার সরালেও, প্রার্থীরা রাতে আবার কয়েকগুণ বেশি লাগিয়ে দিচ্ছেন। ফলে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের শ্রম গিয়ে ঠেকে শূন্যতায়।

পোস্টার লাগাতেও রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা

ঢাকার ১৭, ৮, ১৩, ২, ১০ প্রতিটি আসনের চিত্রই একই। বিশেষ করে ঢাকা ১৭ তে আন্দালিব রহমান পার্থের পোস্টার শহরজুড়ে এমনভাবে ছড়িয়েছে যে, তার প্রার্থীতা এখনো চূড়ান্ত না হলেও প্রচারে তিনি সবাইকে পেছনে ফেলেছেন। জবাব দিতে বলা হলে তিনি নির্বিকারভাবে ফোন কেটে দেন। বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ দলগুলোর পোস্টারই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়; তবে ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও পিছিয়ে নেই। সম্ভাব্য প্রার্থীরা মনে করছেন যত বেশি পোস্টার, তত বেশি পরিচিতি যেন এটা প্রার্থীতার প্রথম ধাপ।

মেট্রোরেল ও এক্সপ্রেসওয়ে সর্বত্র পোস্টার

সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো দেশের সবচেয়ে আধুনিক অবকাঠামো মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রতিটি পিলার আজ রাজনৈতিক পোস্টারে ঢেকে গেছে। কোথাও ৮১০টি পোস্টার পাশাপাশি, কোথাও আবার বিশাল ব্যানার। মেট্রোরেলের রক্ষণাবেক্ষণ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কাও আছে। যেখানে রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় পোস্টার লাগানো অপরাধ, সেখানে আজ পোস্টারের উৎসব চলছে দেদার।

রাজধানী ছাড়িয়ে জেলা মফস্বলেও একই চিত্র

পোস্টার রাজনীতি শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ নয় চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, ময়মনসিংহ, রংপুর সব জায়গায় আচরণবিধি লঙ্ঘনের মহোৎসব।

চট্টগ্রাম: মহাসড়ক থেকে অলিগলিসব জায়গায় নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পোস্টার।

সিলেট: বড় বড় বিলবোর্ড ভাড়া নিয়ে লাগানো প্রার্থীদের প্রচার। শহরের প্রধান এলাকাগুলো পোস্টার-প্যানায় আচ্ছাদিত।

বরিশাল: জাদুঘর, হাসপাতাল, কেন্দ্রীয় কারাগারের দেয়াল সবখানেই অবৈধ প্রচারের দখল।

খুলনা: শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ছবি লাগিয়ে ‘অবৈধ প্রভাব’ দেখানোর প্রতিযোগিতা।

রাজশাহী: এক পোস্টারের ওপর আরেক পোস্টার দৃষ্টিকটু পরিবেশের চূড়ান্ত পর্যায়।

ময়মনসিংহ ও রংপুর: সমস্ত মোড়, গলি ও হাটবাজার পোস্টারে ভরা; কেউ অপসারণের উদ্যোগ নিচ্ছে না।

---

ইসি কঠোর অবস্থানে গেলেও মাঠপর্যায়ে এর প্রতিফলন নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর স্বেচ্ছাচারিতা, প্রশাসনের দুর্বলতা এবং সিটি করপোরেশনের দায়িত্বহীনতায় নাগরিক ভোগান্তি বাড়ছে। বিকল্প হিসেবে ডিজিটাল প্রচারণা, নির্দিষ্ট স্থানে পোস্টার বোর্ড, কঠোর আইন প্রয়োগ, জরিমানা ও মামলা, দলগুলোর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা এসবই হতে পারে সমাধান। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায় যে দেশে প্রতিযোগিতা হয় কে কত বেশি পোস্টার লাগাতে পারে, সেখানে আইন কি আদৌ কার্যকর হবে?

ঢাকার দেয়াল উন্নয়নের গল্প বলে না বরং রাজনীতির অনিয়ন্ত্রিত প্রদর্শনীর সাক্ষী হয়ে আছে। পোস্টারের দৌরাত্ম্য শুধু দৃষ্টিকটু নয়; এটি শহরের নান্দনিকতা, পরিবেশ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি। আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই এই পুরনো সত্য আবারও নগরবাসীকে হতাশ করছে। যতদিন রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের আচরণবিধিকে গুরুত্ব না দেবে, যতদিন দেয়ালকে নিজের ‘সম্পত্তি’ মনে করে দখলদারি বন্ধ না হবে, ততদিন ঢাকার সৌন্দর্য পোস্টারের আঠায় আটকে থাকবে। নির্বাচন আসবে-যাবে, সরকার বদলাবে কিন্তু নাগরিকরা এখনো অপেক্ষায়, দেয়াল নোংরা করার এই অপরিবর্তনীয় সংস্কৃতি বদলাবে কবে?






আর্কাইভ