শিরোনাম:
ঢাকা, সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩২
Swadeshvumi
রবিবার ● ২৩ নভেম্বর ২০২৫
প্রচ্ছদ » ইসি ও নির্বাচন » একদিনে জাতীয় ও গণভোট, ইসির সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ
প্রচ্ছদ » ইসি ও নির্বাচন » একদিনে জাতীয় ও গণভোট, ইসির সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ
৭ বার পঠিত
রবিবার ● ২৩ নভেম্বর ২০২৫
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

একদিনে জাতীয় ও গণভোট, ইসির সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ

শায়লা শবনম

---

একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং গণভোট দুটি ভিন্ন প্রকৃতির ভোট একসঙ্গে আয়োজনের সরকারি সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সামনে এক নজিরবিহীন বাস্তবতা তৈরি করেছে। ৩৪ বছর পর গণভোট, আর তার সঙ্গেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইসির ওপর চাপ যেন বহুগুণে বেড়ে গেছে।

ইতিমধ্যে ইসি সরকার থেকে নির্দেশ পেয়েছে একদিনেই দুটি ভোট আয়োজন করতে। এরপর থেকেই সচিবালয় থেকে মাঠ প্রশাসন পর্যন্ত সমন্বয়ের প্রস্তুতি বহু গুণে বেড়েছে। শুধু একটি জাতীয় নির্বাচনই যেখানে বিশাল আয়োজন, সেখানে একই দিনে গণভোট যুক্ত হওয়ায় প্রশাসনিক ব্যয়, কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা, ব্যালট ছাপা, জনবল নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, পরিবহন— প্রতিটি ক্ষেত্রে বাড়তি হিসাব-নিকাশ করতে হচ্ছে কমিশনকে।

ইসিকে এখন একইদিনের মধ্যে দুটি আলাদা ভোট আয়োজনের প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচন যেখানে প্রতিযোগিতা, প্রার্থী, প্রতীক, ফলাফল দ্রুত ঘোষণা সবকিছুই একটি সুসংগঠিত কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে। অন্যদিকে গণভোট, যেখানে ভোটারকে একটি প্রশ্নে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলতে হবে।

সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সদস্য জেসমিন টুলী বলছেন, “একই দিনে দুই ভোট অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং, কিন্তু অসম্ভব নয়। প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ নিখুঁত হলে ইসি এটি সামলাতে পারবে।”

কিন্তু নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. মো. আব্দুল আলীম মনে করেন, বিশেষ করে গণভোটের নকশাগত কাঠামোই বড় ঝুঁকি। “একাধিক ইস্যুকে এক প্রশ্নে এনে ভোট নেওয়া হলে ভোটার বিভ্রান্তিতে পড়বে। এতে গণভোটের লক্ষ্য অর্জন কঠিন।”

অন্যদিকে সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, “দুই ভোটের সঙ্গে জনপ্রত্যাশা পূরণ করাও বড় চাপ। জনগণ চায় নির্বাচন সুষ্ঠু হোক সেই প্রত্যাশাই আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ।”

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইসির সচিব আখতার আহমেদের সতর্কবাণী, “লজিস্টিক সমন্বয়ই সবচেয়ে কঠিন। ব্যালট, বাক্স, কর্মী, পরিবহন সবই আলাদাভাবে প্রস্তুত করতে হবে।”

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ৪৩ হাজার, ভোটকক্ষ প্রায় ২.৪৫ লাখ। সাধারণত একজন ভোটার ৪০-৫০ সেকেন্ড সময় নেন। কিন্তু এবার দুটি ব্যালট নিতে হবে, দুটি সিল দিতে হবে, দুটি আলাদা বাক্সে ফেলতে হবে। এতে সময় গড়ে ১৫-৩০ সেকেন্ড পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।

গবেষণা অনুযায়ী নারী বুথে প্রতি ভোটারের গড় সময় হতে পারে ৫৭ সেকেন্ড, পুরুষ বুথে প্রায় ৪৮ সেকেন্ড। ফলে লাইন দীর্ঘ হবে, প্রবীণ ও নারী ভোটারের অংশগ্রহণ কমে যেতে পারে, কেন্দ্রের ভেতরে ভিড় ও উত্তেজনা বাড়বে, ভোট গ্রহণের গতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেন্দ্রভিত্তিক উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ করাই ইসির সবচেয়ে কঠিন বাস্তব চ্যালেঞ্জ। কেন্দ্র বাড়ানো সম্ভব না হলেও অতিরিক্ত বুথ বাড়ানোর প্রয়োজন হবে এর মানে ব্যয় ও জনবল দুটোই বাড়বে।

দুটি ভোট সামলাতে মাঠে নামবে প্রায় ৯-১০ লাখ কর্মকর্তা। কিন্তু তাদের প্রশিক্ষণ এবার অতিরিক্ত জটিল। কারণ জাতীয় নির্বাচনের গণনা হয় প্রার্থীভিত্তিক, গণভোটের গণনা হয় ‘হ্যা-না’ ভিত্তিতে, দুটি ব্যালট আলাদাভাবে ব্যবস্থাপনার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, ভুল সিল, ভুল বাক্স, ভুল গণনা, এগুলোই বড় বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে।

জেসমিন টুলী স্পষ্টভাবে বলেছেন, “প্রশিক্ষণ নিখুঁত না হলে ভোটের দিনে ছোট একটি ভুলও বড় রাজনৈতিক বিতর্কে রূপ নিতে পারে।” মানুষের ভুল এটিই এখন প্রশাসনিক প্রস্তুতির সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তা।

গণভোটের চ্যালেঞ্জ প্রচারণা, বিভ্রান্তি ও গণনা

১. প্রচারণা ও সচেতনতার অভাব গণভোটে কোনো প্রার্থী নেই। ফলে, তেমন প্রচারণা হয় না, মানুষের আগ্রহ কম থাকে, দলগুলো সংসদ নির্বাচনের প্রচারণাতেই ব্যস্ত। এ অবস্থায় সাধারণ ভোটারদের কাছে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলতে কোন বিষয় বোঝানো হচ্ছে তা স্পষ্ট করাই কঠিন। বিশেষ করে গ্রামীণ, নিরক্ষর ও অনলাইনবহির্ভূত জনগোষ্ঠীর মধ্যে।

২. এক প্রশ্নে চারটি ইস্যু গণভোটের প্রশ্নে চারটি বিষয় একত্রিত করা হয়েছে যা ভোটারের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে।

ড. আলীম বলেছেন, “এক প্রশ্নে বহু ইস্যু ভোটারদের বিভ্রান্ত করবে। সিদ্ধান্ত নিতেই তারা অনিশ্চয়তায় পড়বে।”

৩. গণনা: দুটি ফল, দুটি ঝুঁকি— জাতীয় নির্বাচনের ফল দ্রুত প্রকাশ না হলে রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়বে। গণভোটের গণনায় ভুল হলে সরকারের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হবে। দুটি ফল একসঙ্গে সামলাতে ইসির ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে।

নিরাপত্তা: দুটি ভোট মানে দ্বিগুণ সংবেদনশীলতা

গণভোট যুক্ত হওয়ায় এবার নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও জটিল। ভোটকেন্দ্র নিয়ে উত্তেজনা, ‘না’ ভোট প্রচারণা নিয়ে বিরোধ, প্রার্থীভিত্তিক উত্তাপ ও দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা, একসঙ্গে দুই ফল প্রকাশ।

এসব বিবেচনায় ইসি দেশকে রেড–ইয়েলো–গ্রিন জোনে ভাগ করে নিরাপত্তা পরিকল্পনা করছে। ৮ লাখের বেশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যকে দ্বিগুণ দায়িত্ব পালন করতে হবে। একটি কেন্দ্রের অপব্যবস্থাপনা, উত্তেজনা, দেড়ি সবই বড় রাজনৈতিক বিতর্কে রূপ নিতে পারে।

কোথায় বাড়বে ব্যয়?

ইসি সচিবালয়ের হিসাব অনুযায়ী ব্যয় বাড়বে ১০-২০% পর্যন্ত। কারণ দুটি ব্যালট ছাপা, দুটি ব্যালট বাক্স, অতিরিক্ত বুথ, লোকবল বাড়ানো, প্রবাসীদের পোস্টাল ব্যালট, পরিবহন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

জেসমিন টুলীর মতে, “আলাদাভাবে গণভোট করলে ব্যয় আরও বাড়ত; একই দিনে করলে কিছুটা সাশ্রয় হলেও মোট ব্যয় বাড়বেই।”

লজিস্টিক সমন্বয়: সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ

নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা এটিকে বলছেন— “অপারেশনাল মেগা-চ্যালেঞ্জ।” কারণ দুটি ব্যালট, দুটি বাক্স, দুটি গণনা প্রক্রিয়া, দুই ধরনের সিল, দুই দলের কর্মী, দ্বিগুণ পরিবহন ও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যালট বিতরণ।

ইসি সচিব আখতার আহমেদের ভাষায় “যা জাতীয় নির্বাচনে ভুল হবে, তা গণভোটের ফল নষ্ট করবে; আর গণভোটে ভুল হলে জাতীয় নির্বাচনেও বিতর্ক তৈরি হবে—দুটি ফলই ঝুঁকিতে।”

আইনি কাঠামো ও সময়: ইসির ওপর আরও চাপ

সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, “গণভোটের আইন চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি নেওয়া যাবে না।” ডিসেম্বরে তফসিল—ফেব্রুয়ারিতে ভোট। আইন, ব্যালট ডিজাইন, গণনা পদ্ধতি, প্রচারণার নির্দেশিকা সবকিছুই আইন প্রণয়ন ও গেজেট হওয়ার ওপর নির্ভর করছে। ফলে সময়সীমা সংকুচিত এবং চাপ ক্রমবর্ধমান।

সফল হলে ইতিহাস, ব্যর্থ হলে বিতর্ক

একদিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন এটি শুধু প্রশাসনিক কাজ নয়, এটি ইসির সক্ষমতার সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা। কেন্দ্রে সময় ব্যবস্থাপনা, প্রশিক্ষণ, লজিস্টিক সমন্বয়, গণভোটের সচেতনতা, নিরাপত্তা পরিকল্পনা, সব মিলিয়ে এটি বাংলাদেশের আধুনিক নির্বাচন ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সমন্বিত কর্মযজ্ঞ। ইসি যদি সফলভাবে এটি সম্পন্ন করতে পারে— এটি দেশের নির্বাচনি ইতিহাসে এক নতুন মাইলফলক হবে। অন্যথায় উভয় ভোটকে ঘিরে দীর্ঘস্থায়ী বিতর্কের ঝুঁকি রয়েই যাচ্ছে।






আর্কাইভ