বুধবার ● ১৫ নভেম্বর ২০২৩
প্রচ্ছদ » জাতীয় » দ্বাদশ সংসদের ভোট ৭ জানুয়ারি
দ্বাদশ সংসদের ভোট ৭ জানুয়ারি
জাতির উদ্দেশে সিইসি’র ভাষণ
# সংঘাত ও সহিংসতা পরিহার করে ঐক্যের তাগিদ
বিশেষ প্রতিনিধি
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন। গতকাল বুধবার সন্ধ্যা ৭টায় জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। ইসির ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আগামী ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি (রবিবার) দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনশ’ আসনে ভোট অনুষ্ঠিত হবে।
এই নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ৩০ নভেম্বর। মনোনয়নপত্র বাছাই হবে ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১৭ ডিসেম্বর ডিসেম্বর। প্রতীক বরাদ্দ ১৮ ডিসেম্বর। ভোটের জন্য ৬৬ জন রিটার্নিং অফিসার এবং ৫৯২ জন সহকারী রিটার্নিং অফিসারের নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়েছে। রিটার্নিং অফিসারের আদেশের বিরুদ্ধে কমিশনে আপীল দায়ের ও নিষ্পত্তির সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ১৭ ডিসেম্বর, রিটার্নিং অফিসাররা প্রতীক বরাদ্দ দেবেন ১৮ ডিসেম্বর এবং ভোটের জন্য নির্বাচনি প্রচারণা চলবে আগামী ১৮ ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত।
সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের এই ভাষণটি বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারসহ দেশের সকল গণমাধ্যমে সরাসরি লাইভ সম্প্রচার করা হয়। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২৩ দফা (৩) উপদফা (ক)-এর বরাতে এবং নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিইসি সংসদ নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণা করেন। জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার আগে বিকেল ৫টায় নির্বাচন ভবনে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন। সেখানেই সংসদ নির্বাচনের তফসিল চূড়ান্ত করা হয়। সংবিধান অনুযায়ী, জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া এই ভাষণের মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
দেশবাসীর উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে সিইসি বলেন, আগামী সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করতে এই প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট সকলের সমন্বিত সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকল প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলকে আচরণ বিধিমালা প্রতিপালন এবং নির্বাচনি দায়িত্বে নিয়োজিত সকল কর্মকর্তাকে আইন ও বিধি-বিধান যথাযথভাবে অনুধাবন, প্রতিপালন ও প্রয়োগ করে সততা ও নিষ্ঠার সাথে আরোপিত দায়িত্ব পালন করার নির্দেশ দেন। জানান, নির্বাচনবিষয়ক আইন ও বিধি-বিধান তাঁদেরকে অবহিত করার লক্ষ্যে কমিশন বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে এবং করে যাচ্ছে।
দেশের চলমান রাজনৈতিক সংঘাত পরিহার করে সমাধান অন্বেষণে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধানের পথ খুঁজে নিতে দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান প্রধান নির্বাচন কমিশনার। নির্বাচনের জন্য কাঙ্ক্ষিত অনুকূল ও উৎসবমুখর রাজনৈতিক পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে সিইসি বলেন, ‘নির্বাচন প্রশ্নে, বিশেষত নির্বাচনের প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতির প্রশ্নে, দীর্ঘসময় ধরে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক নেতৃত্বে মতভেদ পরিলক্ষিত হচ্ছে। বহুদলীয় রাজনীতিতে মতাদর্শগত বিভাজন থাকতেই পারে। কিন্তু মতভেদ থেকে সংঘাত ও সহিংসতা হলে তা থেকে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বিরূপ প্রভাব বিস্তার করতে পারে। মতৈক্য ও সমাধান প্রয়োজন।
আমি নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সকল রাজনৈতিক দলকে বিনীতভাবে অনুরোধ করব- সংঘাত ও সহিংসতা পরিহার করে সদয় হয়ে সমাধান অন্বেষণ করুন। পারষ্পরিক প্রতিহিংসা, অবিশ্বাস ও অনাস্থা পরিহার করে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধান অসাধ্য নয়। কারণ পরমতসহিষ্ণুতা, পারষ্পরিক আস্থা, সহনশীলতা ও সহমর্মিতা টেকসই ও স্থিতিশীল গণতন্ত্রের জন্য আবশ্যকীয় নিয়ামক’।
দেশবাসীর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘জনগণকে অনুরোধ করব সকল উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও অস্বস্তি পরাভূত করে নির্ভয়ে আনন্দমুখর পরিবেশে ভোটকেন্দ্রে এসে অবাধে মূল্যবান ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনে সকল দলের স্বত:স্ফুর্ত অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে সর্বদা স্বাগত জানাবে। জাল ভোট, ভোট কারচুপি, ব্যালট ছিনতাই, অর্থের লেনদেন ও পেশিশক্তির সম্ভাব্য ব্যবহার নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে। তাই জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যে কোনো মূল্যে সম্মিলিতভাবে তা প্রতিহত করার আহ্বান জানান সিইসি। ভোটকেন্দ্রসমূহের পারিপার্শ্বিক শৃঙ্খলাসহ প্রার্থী, ভোটার, নির্বাচনি কর্মকর্তাসহ সর্বসাধারণের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন।
নির্বাচনের প্রস্তুতি তুলে ধরে সিইসি বলেন, সবশেষ হালনাগাদ ভোটার তালিকা এবং নির্বাচনি এলাকার সীমানা পুনঃ নির্ধারণের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। নতুন রাজনৈতিক দল এবং আগ্রহী দেশি ও বিদেশি পর্যবেক্ষকদের নিবন্ধন প্রত্রিয়াও সমাপ্ত প্রায়। দেশে এবার মোট ভোটার প্রায় ১১ কোটি ৯৭ লাখ। প্রায় ৪২ হাজার ভোটকেন্দ্রের বুথ করা হয়েছে ২ লাখ ৬২ হাজার।
এবারের নির্বাচনকে সফল ও ফলপ্রসূ করতে প্রার্থীদের প্রতি সিইসি বলেন, নির্বাচনের অন্যতম অনুসঙ্গ হচ্ছে কার্যকর প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কেন্দ্রে কেন্দ্রে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সাহসী, সৎ, দক্ষ ও অনুগত পোলিং এজেন্ট নিয়োগ করে প্রার্থী হিসেবে আপনাদের নিজ নিজ অধিকার ও স্বার্থ সুরক্ষার প্রাণান্ত চেষ্টা কার্যত: আপনাদেরকেই করতে হবে। গণতান্ত্রিক নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় এটি একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। নির্বাচনি দায়িত্বে নিয়োজিত সকল কর্মকর্তা সৎ, নিরপেক্ষ ও অবিচল থেকে আইন ও বিধি-বিধান অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করবেন।
নির্বাচনি দায়িত্বে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট সকলকে দায়িত্বশীল আচরণ ও আবশ্যক ভূমিকা পালন করে এই জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে দেশে ও বহির্বিশ্বে প্রশংসিত ও বিশ্বাসযোগ্য করার আহ্বান জানান সিইসি। বলেন, দেশের জনশাসনে জনগণের জনপ্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে হবে। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সকল রাজনৈতিক দল ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীসহ আপামর জনগণের আন্তরিক অংশগ্রহণ ও সক্রিয় সহযোগিতা কামনা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার।
এমন এক সময় সিইসি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করলেন, যখন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন দুই শিবিরে বিভক্ত। সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সারা দেশে অবরোধের কর্মসূচি পালন করছে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করার অবস্থানে অনঢ়। সামনে কী হতে যাচ্ছে, তা নিয়ে জনমনে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। দশ বছর আগের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের স্মৃতি ফিরে ফিরে আসছে।
এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশে মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন। ২ নভেম্বর সংসদ নির্বাচনের চূড়ান্ত ভোটারসংখ্যা প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইসির তথ্য অনুযায়ী, মোট ভোটারের মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৭ লাখ ৭১ হাজার ৫৭৯ জন। নারী ভোটার ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৯ হাজার ২০২ জন। আর তৃতীয় লিঙ্গের ভোটারের সংখ্যা ৮৫২। বর্তমানে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দল ৪৪টি। এসব দল ছাড়াও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। এবারের নির্বাচনে সম্ভাব্য ভোটকেন্দ্র ৪২ হাজার ১০৩টি এবং ভোটকক্ষ ২ লাখ ৬১ হাজার ৯১২।
চলতি একাদশ সংসদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি, সেই সংসদের মেয়াদ আগামী বছরের ২৯ জানুয়ারি শেষ হচ্ছে। ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তা অনুসারেই বুধবার তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন পরিচালনাকারী সাংবিধানিক সংস্থাটি।
বিষয়: #দ্বাদশ সংসদের ভোট ৭ জানুয়ারি